দৃঢ়চেতা নারী গান্ধারী

স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন এক নারী। কথা বলতে চান কৌরবপুত্র দুর্যোধনকে নিয়ে। ধৃতরাষ্ট্রকে এই নারী আবেদন জানান "মহারাজ, দুর্যোধন জন্ম গ্রহণ করলে মহামতি বিদুর বলেছিলেন এই কুলপাংশুল শিশুকে অবিলম্বে সংহার করো। এতে মঙ্গল হবে। জন্ম মাত্র সে গর্ধভের মত চিৎকার করেছিল। দুর্যোধন এই কুলের কলঙ্ক। আপনি ওঁকে পরিত্যাগ করুন।" এক নারী এই কথাগুলো বলেছে। মানসিক দৃঢ়তা, সাহস দুই-ই সঙ্গ দিয়েছে তাঁকে। তাই নিজের স্বামীকে সত্যি কথাগুলো স্পষ্ট ভাবে বলতে একটুও ভয় পাননি সেই নারী। বৈদিক যুগের এমন সাহসী নারী ছিলেন গান্ধারী।

মহাভারতের একটি চরিত্র বাদেও গান্ধারীর পরিচয় ছিল সে সাহসিনী,বুদ্ধিমতী। সত্যি কথা বলতে পছন্দ করতেন। তাই নিজের মহিমা ও ঐশ্বর্যে ঝলমল করে গেছেন মহাকাব্য জুড়ে। গান্ধারীর চরিত্রের তিনটি গুণ তাঁকে আলোকপ্রাণা হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন। স্বামীর প্রতি কর্তব্যবোধ, অপরিসীম ধৈর্য এবং ধর্মের পথে দৃঢ় থাকা। এর জেরেই তিনি অন্যরকম চরিত্র হয়ে উঠেছেন মহাভারতে।

ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে সিন্ধু নদের এপার-ওপার জুড়ে ছিল প্রাচীন গান্ধার দেশ। সেই দেশের রাজা ছিলেন সুবল। সুবল রাজার কন্যা গান্ধারী। গান্ধার দেশের মেয়ে বলে তার নাম গান্ধারী।

হস্তিনাপুরের কৌরববংশীয় রাজা বিচিত্রবীর্য অল্প বয়সে মারা যান। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র হয়েও ধৃতরাষ্ট্র সিংহাসনে বসতে পারেননি কারণ তিনি জন্মান্ধ। রাজা হন তার সৎ ভাই পান্ডু। শোনা যায় সুবল রাজার কন্যা গান্ধারী ভবানীপতির আরাধনা করে বর লাভ করেছেন। এই বরপ্রাপ্তা নারী, পতিব্রতা এবং শত পুত্রের জননী হবে। বাবার ইচ্ছেতেই দৃষ্টিশক্তিহীন ধৃতরাষ্ট্রকে বিয়ে করেন গান্ধারী। স্বামীর প্রতি কর্তব্যবোধে অবিচল থাকার জন্য গান্ধারী একটি কাপড়ের টুকরো দিয়ে নিজের চোখ দুটো বেঁধে নেন। সেই বাঁধন আজীবন সঙ্গে রেখেছিলেন। এমন মনের নারী কিন্তু স্বামীর অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন বারবার।

মহাভারতে আমরা দ্রৌপদীর অসম্মান স্পষ্টভাবেই দেখতে পাই। দ্রৌপদীকে অপমানের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন গান্ধারী। দুর্যোধন সভার মধ্যে দ্রৌপদীকে চূড়ান্ত অপমান করেন। কৌরব পক্ষের কেউই তার প্রতিবাদ করেনি। দ্রৌপদীকে যখন সবার মধ্যে বিবস্ত্র করার চেষ্টা হয়েছিল, ধৃতরাষ্ট্র সেই সময়ও মৌন ছিলেন। কিন্তু এসময় তাকে কাতর মিনতি জানান গান্ধারী। গান্ধারীর মিনতিতে তিনি দ্রৌপদীকে বর দিতে চেয়েছিলেন, এমনকী গান্ধারীর জন্যেই ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনকে তিরস্কার করেন। দ্রৌপদী তারপর পাশার পণ থেকে যুধিষ্ঠিরের মুক্তি চেয়ে নিয়েছিলেন। নেপথ্যে তাকে সাহায্য করেছিলেন এই গান্ধারী।

ধৃতরাষ্ট্র এরপরেও দুর্যোধনকে বারবার সাহায্য করতে চেয়েছেন, আটকেছিলেন গান্ধারী। কৌরবদের অন্যায় দেখে তার অন্তরাত্মা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। নিজের সন্তানের অন্যায়কেও তিনি কখনও ক্ষমা করেননি। এমনকি নিজের সন্তানের অন্যায় দেখে স্বামীকেও কটু কথা শোনাতে পিছপা হননি।

দুর্যোধনের পাপ, অন্যায় নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন ধৃতরাষ্ট্রকে। গান্ধারী ছিলেন তপস্বিনী। তাঁর রাগ, তাঁর অনুভূতি, সততা তাঁকে মহান করেছে। প্রয়োজনে তিনি কৌরবদের প্রশ্ন করেছেন। আবার কখনও সন্তান-শোকে জর্জরিত হয়ে পান্ডবদের অভিশাপ দিতে চেয়েছেন। পান্ডবরা জানতেন গান্ধারী তপস্বিনী, তাঁর অভিশাপ ফলবেই। তাই তাঁকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেছেন। এমনকি কখনও স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণকে পাঠিয়েছিলেন গান্ধারীর কাছে। গান্ধারীর হৃদয় গলানোর জন্য।

তবে মেধাবিনী, সাহসিনী এই নারী সন্তানকে হারিয়ে শেষ বেলায় আকুতি জানিয়েছিলেন পান্ডবদের কাছে। যুধিষ্ঠিরকে তিনি প্রশ্ন করেছেন "আমাদের যে সন্তানেরা একটু কম অপরাধ করেছিল, তাঁদের কি কোন ভাবে বাঁচিয়ে রাখা যেত না! শেষ বয়সে তাঁরা আমাদের অন্ধের যষ্টি হত তাহলে।"

ভীম অন্যায় ভাবে দুর্যোধনকে হত্যা করেছিলেন। দুর্যোধন, দুঃশাসন এদের মৃত্যুতে গান্ধারী কখনও বিলাপ করেননি। তবে অন্যায়ভাবে দুর্যোধনকে হত্যা করার জন্য তিনি শেষে ভীমকে প্রশ্ন করেছেন। ভীম দুর্যোধনকে নাভির নিচে আঘাত করে হত্যা করেছিলেন, এই অধর্ম সহ্য করতে পারেননি গান্ধারী। তিনি বলেছেন "আমি জানি দুর্যোধন, দুঃশাসন নিজেদের দোষেই মৃত্যুবরণ করেছে। কিন্তু তাঁদের অন্যায় ভাবে হত্যা করার বিরোধিতা করি আমি।" তিনি পান্ডবদের অভিশাপ দিতে চেয়েছেন। মহাকাব্যে গান্ধারীর ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা, তাঁর ক্ষমা করার মহৎ গুণ তাঁকে এক অনন্য নারী হিসেবে প্রতিবিম্বিত করেছে। কখনও মহাকাব্যে তাঁকে মানসীকন্যা হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু তিনি যে দৃঢ়চেতা রক্ত মাংসের গড়া এক নারী, তা তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...