মল্লিকবাড়ির এই সদস্যের হাত ধরেই বসু মল্লিক পরিবারের বনেদিয়ানার যাত্রা শুরু

হুগলি ডক ইয়ার্ডের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে প্রথম ভারতীয় হিসেবে জড়িয়ে রয়েছে রাধানাথ বসু মল্লিকের নাম। কলকাতার একটি কোম্পানিতে মাসিক ১২টাকা বেতনে শুধু চাকরি নয়, জীবন শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর ব্যবসায়ী বুদ্ধি, নিষ্ঠা, অধ্যাবসায় তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল ব্যবসার ক্ষেত্রে এক চূড়ান্তসীমায়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নদীপথে কলকাতার ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়লে জাহাজ মেরামত এবং জাহাজ রাখার জন্য বন্দরের প্রয়োজন হবে। এবং জলপথে ব্যবসা করার অসুবিধাগুলো পেরোতে পারলে সুবিধের ভাগটাই বেশি। তাই হুগলি ডক ইয়ার্ড তৈরি হয়েছিল তাঁর র তত্ত্বাবধানে। হুগলি ডক ইয়ার্ড মধ্য কলকাতার এই বাঙালির বিচক্ষণ ব্যবসা বুদ্ধির এক অন্যতম নিদর্শন। এই পরিবারের উত্তরাধিকারীরাও হুগলি ডকে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করে সাফল্যের নিদর্শন রেখেছেন।

রাধানাথ বসু মল্লিক মারা যান ১৮৪৪ সালে। ব্যবসা করে বসু মল্লিক পরিবার তখন লক্ষ লক্ষ টাকা বিষয় সম্পত্তির মালিক। এই টাকা  মল্লিক পরিবার মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা দিগম্বর মিত্র ও কৃষ্ণ দাস পালসহ নানা গুণী ব্যক্তির মধ্যে বন্টন করে দেন।মল্লিক  পরিবারের তরফ থেকে সমাজসেবার সাধনায় যুক্ত থাকা মানুষদের মধ্যেই এই অর্থ ভাগ করে দেবার প্রচেষ্টা করা হয়।

তাঁদের তৈরি হুগলি ডক উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন রাধানাথ বসু মল্লিকের ছেলে জয় গোপাল বসু মল্লিকের তিন ছেলে। অর্থাৎ রাধানাথ বসু মল্লিকের তিন নাতির মধ্যে হুগলি ডকের সম্পত্তি ও দায়িত্ব ও ভাগ করে দেওয়া হয়। তাঁরা ছিলেন প্রবোধ চন্দ্র বসু মল্লিক, মন্মথ চন্দ্র বসু মল্লিক, এবং হেমচন্দ্র বসু মল্লিক। হেমচন্দ্র বসু মল্লিকের তত্ত্বাবধানে একই বাড়িতে লালিত-পালিত হয়েছিলেন তাঁর ছেলে নীরদ চন্দ্র বসু মল্লিক ও বড় দাদার ছেলে সুবোধ চন্দ্র বসু মল্লিক। এই সুবোধ চন্দ্র বসু মল্লিক পরবর্তীকালে রাজা উপাধি পেয়েছিলেন এবং তার নামে কলকাতায় রাস্তাও রয়েছে।

নীরদ চন্দ্র বসু মল্লিক পড়াশোনা করেছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। তারপর কিছুদিন জাপানে কাটিয়ে আসেন। ফিরে এসে পৈতৃক হুগলী ডকের কাজে যোগদান তিনি। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তিনি ডকের টিনের শেডের নিচে দাঁড়িয়ে আর পাঁচজন কর্মীর মত কাজ করতেন। সকলের সঙ্গে মিশে গিয়ে কাজ করতে ভালোবাসতেন তিনি। তাঁর ব্যবহার এবং কাজ করার ধরনে সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে কোন তফাৎ ছিল না। কাজের ক্ষেত্রে এই তফাৎ না রক্ষা করার মত নিয়ম সচেতন ভাবেই রক্ষা করতেন। ব্যক্তিগত নিষ্ঠা ও কর্ম ক্ষমতায় পৈতৃক সম্পত্তি কয়েক গুণ বাড়িয়েছিলেন তিনি। আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে তার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে গিয়েছিলেন। বরাবর কোমল ও উদার হৃদয়ের মানুষ ছিলেন তিনি। কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যহীনতা প্রতিস্থাপিত করার ব্যাপারে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য বলে স্বীকার করা হয়।

রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের পূর্ব দিকে তাঁর বাড়িটি তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেছিলেন। ১২ নম্বর ওয়েলিংটন স্কোয়ারের বাড়িটিও পরে সুবোধ চন্দ্র বিক্রি করে দিয়েছিলেন নীরদ চন্দ্রকে। নীরোদ চন্দ্র ও সুবোধ চন্দ্র শুধু একই সঙ্গে মানুষ হননি দান ও শিক্ষার ব্যাপারেও তাঁরা দুজনেই ছিলেন একই পথগামী। সুবোধ চন্দ্র বসু মল্লিক এক জন সভায় সমাজসেবার কাজে একটা বিরাট অংকের টাকা দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই টাকায় জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ভিত্তি স্থাপিত হয়, পরবর্তীকালে এটাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উঠে আসে। এই জনসভা এবং এমন আর্থিক সাহায্যের কারণেই পরবর্তীকালে মানুষ সুবোধচন্দ্রকে রাজা উপাধি দিয়েছিলেন। তখন সুবোধচন্দ্রের বয়স ছিল মাত্র ২৬। তাঁর ঘোড়া খুলে রেখে ছাত্রছাত্রীরা মিলে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন। বাংলার শিক্ষা ও শিক্ষা জগতে পটলডাঙ্গার এই বসু মল্লিক পরিবার অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। তবে এই পরিবার তথ্যের উল্লিখিত সাহায্যের বাইরে ও আরো অনেক সাহায্য করেছেন কলকাতাকে। শহরবাসীর জন্য আরো অনেক কিছু গড়ে দিয়েছেন। যা আজও আড়ালেই রয়ে গেছে। এভাবেই তাঁরা নিঃশব্দে কাজ করে গেছেন কলকাতার জন্য।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...