১৮৯২ সালে তৈরি একটা রাস্তা। যার নাম মদন গোপাল লেন। মদন গোপাল দের নামে তৈরি হওয়া রাস্তা। পরিবারের সকলেই বলরাম জিউয়ের ভক্ত ছিলেন। ঠাকুরদালানে আজও একটি বড় টানা পাখা রয়েছে। সাদা পাথরের লেখা প্রতিষ্ঠা ফলকে চকচক করে বাড়ির নাম। অষ্টাদশ শতকের পরিচিত বনেদি পরিবার দে পরিবার। মদন গোপাল দের আমলে এই পরিবারের ধর্মনিষ্ঠার খ্যাতি কলকাতার সীমানা ছাড়িয়ে যায়। তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর নামে কলকাতা কর্পোরেশনের আড়পুলি লেনের একটি অংশের নাম রাখা হয় মদনগোপাল লেন।
এই দে পরিবারের আদি নিবাস চন্দননগর। মদন গোপালের দাদু পীতাম্বর দে চন্দননগর থেকে কলকাতায় এসে কলুটোলায় একটি বাড়ি কিনেছিলেন। মূলত ব্যবসার জন্যেই তাঁরা কলকাতায় আসেন। কিন্তু এসেই আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েন। কলকাতার জীবন ধারণ, খরচ-খরচা সামলাতে সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছিল। হাল ধরেছিলেন মদন গোপাল। পরিবারের গ্রাসাচ্ছদনের জন্য মাসিক ১৬ টাকা বেতনে তিনি একটি কোম্পানির হিসেবপত্র দেখাশোনার কাজ শিখতে শুরু করেছিলেন। পরে বেতন বেড়ে হয় ৫৫ টাকা। এরপর গ্রেহাম কোম্পানিতে ৭৫ টাকা বেতন হওয়া পর্যন্ত কাজ করেছিলেন। হিল্জার্স কোম্পানিতে মদন গোপাল বেনিয়ান বা মুৎসুদ্দি তারকনাথ মল্লিকের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। তারকনাথের মৃত্যুর পর কোম্পানির যাবতীয় রপ্তানি কার্যের দায়িত্ব পেয়েছিলেন মদন গোপাল। তাঁর বেতন বেড়ে দাঁড়িয়েছিল দেড়শ টাকা। পরে এই কোম্পানির বেনিয়ান ও হয়েছিলেন তিনি।
পরিবারকে আর্থিক বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন মদন গোপাল। মিতব্যয়ী ছিলেন। অর্থ সঞ্চয় করে ১৮৬৬ সালে তিনি ৫ ও নম্বর আড়পুলি লেনে প্রায় ৭ কাঠা জমি কিনে বাড়ি তৈরি করেছিলেন। এই বাড়িটি পরে সম্প্রসারিত করা হয়। তার জন্য আরো জমি কেনা হয়েছিল। বর্তমানে মোট তিনটি নম্বর রয়েছে মদন গোপাল দের বাড়ির। তাঁর জীবদ্দশাতেই আড়পুলি লেনের নাম বদলে মদন গোপাল লেন রাখা হয়েছিল।
কলকাতার এই বনেদি পরিবার মূলত তাঁদের ধর্মনিষ্ঠতার কারণেই চর্চায় ছিল। এঁদের আদি নিবাস ছিল চন্দননগরে। জগদ্ধাত্রী পুজোর উত্তরাধিকার এরা কলকাতাতেও মহাসমারোহে বহন করেছেন। পালন করেছেন রাস, ঝুলনের মতো উৎসব। মদন গোপাল নিজে তাঁর বাড়িতে প্রতিদিন ধর্মগ্রন্থ পাঠের ব্যবস্থা করেছিলেন। নীলকান্ত গোস্বামী তাঁকে টানা ১৪ বছর শ্রীমদ্ভগবত গীতা পড়ে শুনিয়েছিলেন। আরাধ্য দেবতা ছিল বলরাম জিউ। মদন গোপাল-এর পরিবারের ধর্মনিষ্ঠা ও সাবেক কালের রীতিনীতি এখনও বজায় রয়েছে। বাড়ির মেয়েরা এখনও ফ্রিল দেওয়া থ্রি-কোয়ার্টার ব্লাউজ ও পুরনো কায়দায় শাড়ি পরে তুলসী তলায় প্রদীপ দেন। এই পরিবারের পুরোহিত বংশপরম্পরায় এখানেই পৌরহিত করেন।
কষ্ট করে মদন গোপাল নিজের পরিবারকে দাঁড় করালেও তাঁর পরিবারের বাকিরা ব্যবসায় মন দিয়েছিলেন। তাঁর ছয় ছেলে ছিল। তাঁদের মধ্যে তিনজনের সোনা রুপোর দোকান ছিল। বাকিরা তবে চাকরি করেছেন। এই পরিবারের সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর বিশেষ সম্পর্ক ছিল। মদন গোপাল-এর ছেলে শশীভূষণ দে সবচেয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
শশীভূষণ দের জন্ম ১৮৬৮ সালের ৫ নভেম্বর। হিন্দু, হেয়ার, বঙ্গবাসী, সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে তিনি পড়াশোনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে মদন গোপাল তাকে একটি কোম্পানিতে কাজের জন্য নিযুক্ত করেন। যদিও পরে সেই ছেলে সোনার রূপোর ব্যবসায় আসে। তবে শেয়ার বাজারে কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার পর রীতিমতো ভাগ্য খুলে যায় শশীভূষণ দের। শেয়ার বাজারের থেকে প্রচুর কমিশন পেতেন তিনি। শশীবাবু পরে কলকাতার স্টক এক্সচেঞ্জ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠা হিসেবে গণ্য হন।
তবে এই পরিবার বরাবর দয়া-পরবশ ছিলেন। যক্ষ্মা রোগে নিজের ছেলেকে হারিয়েছিলেন শশীভূষণ। কার্শিয়াঙে তাই একটি স্যানাটোরিয়াম খুলে ছিলেন। ৯০ বছর বেঁচেছিলেন শশীভূষণ। কলকাতা মেডিকেল এন্ড রিসার্চ সোসাইটি, যাদবপুর যক্ষ্মা হাসপাতাল ও কার্শিয়াং-এর স্যানাটোরিয়ামে নগদ টাকায় তিনি প্রায় চার লক্ষ আশি হাজার টাকা দান করেছিলেন। অনেক বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তিনি টাকা দান করেছিলেন।
শশীভূষণের পরিবার তবে শেয়ার বাজারের সঙ্গে সম্পর্ক কিন্তু কখনই ছিন্ন করেনি। তাঁর এক ভাইপো দীর্ঘ ৪০ বছর এখানে ব্যবসা করেছেন। শিক্ষিত এই বনেদি পরিবার সেই সময় কলকাতার অন্যতম চর্চিত পরিবার ছিল।