তারাপীঠের মহিমা

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার রামপুরহাট শহরের কাছে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র মন্দির নগরী হলো শক্তিপীঠ তারাপীঠ। এই শহর তন্ত্রের দেবী তারা এবং মন্দির সংলগ্ন মহাশ্মশান ক্ষেত্রের জন্য বিখ্যাত। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী, এই মন্দির ও তার সংলগ্ন এই শ্মশান একটি অত্যন্ত পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। হিন্দু পুরাণ মতে, দক্ষ যজ্ঞে সতীর দেহত্যাগের পর মহাদেব যখন সতীর দেহ নিয়ে প্রলয় নৃত্যের ফলে ধরাধাম যখন রসাতলে যাওয়ার পরিস্থিতি হয়েছিল তখন বিষ্ণুদেব তার চক্রের সাহায্যে সতীদেবীর দেহ ৫১ টি খন্ড করে পৃথিবীর নানা স্থানে ছড়িয়ে দেন। এই ৫১টি জায়গায় যেখানে যেখানে দেবীর শরীরের অংশ পড়েছিল সেইসব জায়গায় গড়ে ওঠে ৫১শক্তিপীঠ।

এই ৫১ শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম হল তারাপীঠ। বলা হয়,  এই স্থানে পড়েছিল দেবীর ঊর্ধ্ব নয়নতারা। দেখতে অন্য মন্দিরের সদৃশ্য হলেও এক মহান তীর্থক্ষেত্র হিসেবে নিজেকে বিকশিত করে তোলার পিছনে রয়েছে মন্দির সংক্রান্ত কিংবদন্তি, পশুবলীসহ পূজাপদ্ধতি, ভক্তিগীতিসমূহ, সংলগ্ন জলাশয়ের অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে লোকবিশ্বাস প্রভৃতি। কথিত আছে, সতীদেবীর তৃতীয় নয়ন বা ঊর্ধ্ব নয়নতারা তারাপীঠ গ্রামে পড়ার পরই প্রস্তরীভূত হয়ে যায়। বশিষ্ঠ মুনি সেই প্রস্তরীভূত শিলাকে কেন্দ্র করে একটি মন্দির গড়ে তোলেন এবং তারা রূপে দেবীর পূজা শুরু করেন। অন্য একটি লোকগাথা অনুযায়ী, বশিষ্ঠ মুনি এই স্থানে এসে তারাদেবীর আরাধনা করতে শুরু করেন। কিন্তু কোনো এক কারণে তিনি আরাধনা সম্পূর্ণ করতে ব্যর্থ হন। তখন তিনি তিব্বতে যান বিষ্ণুদেবের অবতার বুদ্ধের উদ্দেশ্যে। সেখানে তিনি তাঁর সমস্যার কথা জানালে বুদ্ধদেব তাঁকে জানান কিভাবে পুজো করলে সন্তুষ্ট হবেন তারা মা। তাঁর কথা মতো বশিষ্ঠ মুনি তারাপীঠে এসে তিন লক্ষ বার তারা নাম জপ করেন। ভক্তের আকুল ডাকে সাড়া দেন দেবী। মুনিবর তাকে জানান, তিনি মাকে শিশু শিবকে স্তন্যপানরতা হিসেবেই দেখতে চান। দেবী ভক্তের ইচ্ছানুযায়ী, সেই রূপেই ভক্তকে দর্শন দেন এবং সেই মুহূর্তেই প্রস্তরীভূত হয়ে যান। সেই থেকেই তারাপীঠের মন্দিরে শিশু শিবকে স্তন্যপানরতা মূর্তিতেই পূজিত হয়ে আসছেন। বলা হয়, এটি একটি সিদ্ধপিঠ। এই স্থানে এসে সাধনা করলে সাধক পান জ্ঞান, আনন্দ এবং সিদ্ধি।

লোককথা অনুযায়ী, এই মন্দিরের কাছেই রয়েছে একটি জলাশয়। বলা হয় এই জলাশয়ের জলে রয়েছে একটি বিশেষ আরোগ্যপ্রদান ক্ষমতা। মন্দিরে ঢোকার পূর্বে সমস্ত দর্শনার্থী একবার করে সেই পুকুরে ডুব দিয়ে তবেই মন্দিরে প্রবেশ করেন। প্রতিবছর আশ্বিন মাসের কোজাগরী শুক্লা চতুর্দশী তিথিতে মন্দির থেকে প্রস্তরীভূত দেবীকে বাইরে এনে বিরাম মঞ্চে রাখা হয় এবং সেইদিন তারামূর্তিকে প্রকাশ্যে মহাসমারোহে স্নান করানো হয়ে থাকে।

তারাপীঠের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ সাধক ছিলেন মায়ের পাগল ভক্ত বামাক্ষ্যাপা। মন্দিরের নিকটেই ছিল তাঁর বসতভিটে। দেবীর এই একনিষ্ঠ ভক্ত মায়ের মন্দিরে পুজো করতেন এবং তারাপীঠ মহাশ্মশানে সাধনা করতেন। প্রচলিত কথা অনুযায়ী, মায়ের পাগল ছেলে বামা মানতেন না মন্দিরের কোনো নিয়ম। দেবীকে ভোগ নিবেদনের আগে সেই ভোগ নিজে খেয়ে ফেলে সেখানকার পুরোহিতদের রোষ দৃষ্টিতে পড়েছিলেন।  কথিত আছে, তারাদেবী ভীষণা বেশে বামাক্ষ্যাপাকে দর্শন দিয়ে দুগ্ধপান করিয়েছিলেন।

এবার আসা যাক তারাপীঠের মহাশ্মশানের কথায়। শহরের এক কোণায় নদীর ধারে ঘন অরণ্যবেষ্টিত এই শ্মশানটি এক অন্যতম জনপ্রিয় সাধনাক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত।এই শ্মশানটি শক্তিপীঠের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্থানীয় লোকগাথা অনুযায়ী, এই শ্মশানের অন্ধকারে দেবী তারাকে ছাগের রক্ত পান করতে দেখা যায়। সেই থেকে দেবীর যে সকল চিত্রকলা দেখা গেছে সব জায়গাতেই দেবীকে শ্মশানবাসিনীরূপেই দেখা যায়। এই কারণে আজও তন্ত্রসাধকরা তাদের সাধনস্থল হিসেবে এই মহাশ্মশানকেই বেছে নেন।এই মন্দিরে সারাবছরব্যাপী ভক্ত সমাগম হয় চোখে পড়ার মতো।

  

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...