‘গূঢ়পুরুষ’ নির্লোভ হলেই রাজ্যের মঙ্গল বলছে অর্থশাস্ত্র

রাষ্ট্রের সুশাসন, প্রতিরক্ষা ও নিশ্চিত নিরাপত্তার কারণে গুপ্তচর নিয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। কোন নির্দিষ্ট যুগ, সময় বা ক্ষেত্র নয় ইতিহাসের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুপ্তচরবৃত্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখা দিয়েছে। গত পর্বে অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত গুপ্তচরবৃত্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। চাণক্য বা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রকে গুপ্তচর বৃত্তির অন্যতম ইতিহাসের দলিল রূপে ধরে নেওয়া হয়। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শিক্ষক তথা প্রধান উপদেষ্টা চাণক্য বা বিষ্ণু গুপ্ত বা কৌটিল্যের সঙ্গে এই অর্থশাস্ত্রেকে যুক্ত করা হলেও অনেক ঐতিহাসিক বলেন অর্থশাস্ত্র আসলে রাজনীতি বা দ্বন্দ্ব নীতি বিষয়ের একটি সংকলিত গ্রন্থ। এই গ্রন্থের রচয়িতা যে কেবলমাত্র একজন পন্ডিত মানুষ এমনটা নাই হতে পারে।

এই অর্থশাস্ত্রে সম্পদের রক্ষাকারী মানুষ হিসেবে গুপ্তচরের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও মৌর্য্যযুগে এই গুপ্তচরদের গূঢ় পুরুষ বলা হত।

অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রের সাতটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকৃতি বা সপ্তাঙ্গের কথা বলা হলেও এর মধ্যে স্বামী বা রাজাই রাষ্ট্রনায়ক। এই রাষ্ট্রনায়ক নিজেকে বিজিগীষু অর্থাৎ সর্বদা জয়ের আকাঙ্ক্ষা পোষণকারী একজন মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। জয় পেতে গেলে সর্বদা নির্দিষ্ট পন্থা অবলম্বন করতে হয়। সব ক্ষেত্রে জয়লাভকারী রাজাকে বিজিগীষু চক্রবর্তী রাজা বলা হত। অর্থাৎ অর্থশাস্ত্রে বারবার রাজার নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজাকে একাধিক আদেশ পালন করার কথা বলা হয়েছে।

অর্থশাস্ত্রে রাজাকে বাস্তববাদী হওয়ার কথা বলা আছে। একটি রাষ্ট্রনৈতিক শক্তি কখনোই চিরকাল বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে না সেখানে যেমন বন্ধুও গড়ে ওঠে তেমনি শত্রুও গড়ে ওঠে। এই সব কিছু মোকাবিলায় প্রয়োজন সঠিক বৈদেশিক নীতির।এই নীতিবাদ বিষয়টা আত্মশক্তি, প্রভুশক্তি, মন্ত্রশক্তির সমন্বয়ে গঠিত। অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী এই তিনশক্তির আরাধনা করতে হলে বল বা দন্ড সিদ্ধি এই সকল কিছুরও আরাধনা করা প্রয়োজন।

এই দন্ডর আরাধনা করতে গেলে যুদ্ধের সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। রাজ্য চালানোর ক্ষেত্রে সর্বদা অনুকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন যে হওয়া যাবে এমনটা নাই হতে পারে। রাজা অন্যান্য পারিষদের সমর্পণ দাবি করতে পারেন না। যুদ্ধ জিততে গেলে রাজার প্রয়োজন এমন পুরুষ যারা গোপনে রাজাকে গূঢ় তত্ত্ব ও তথ্য দিয়ে সাহায্য করবে। এই ভাবনা থেকেই গূঢ় পুরুষ অর্থাৎ গুপ্তচরের ভাবনার জন্ম।

বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ষঢ়গূণ্য এবং আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক দুই ক্ষেত্রেই সুদৃঢ় ভাবনার অধিকারী এমন গূঢ়পুরুষ প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে অর্থশাস্ত্রে। সকলেই গূঢ়পুরুষ বা গুপ্তচর হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।

অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে রাজা ব্যতীত বাকি সকলেই নজরবন্দি, গোপনে রাজার বিরোধিতা করে সেই তথ্য ও তথ্য দেওয়া গূঢ়পুরুষদের কর্তব্য। রাজার কাজ সঠিক বুদ্ধিমত্তায় গূঢ়পুরুষ অর্থাৎ গুপ্তচর নিয়োগ করা। তাঁদের সঠিক বেতন দেওয়া।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে গূঢ়পুরুষ নিয়োগকে একটি জটিল প্রক্রিয়া হিসেবে দেখানো হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে যে গূঢ়পুরুষ নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় মাথায় রাখা উচিত, সকলের প্রথম তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত। তারপর এদের সততা পরীক্ষা করা উচিত। গূঢ়পুরুষ অর্থাৎ গুপ্তচররা নির্লোভ হলেই রাজ্যের মঙ্গল এমনটাই বলা হয়েছে অর্থশাস্ত্রে।

এই গুপ্তচর নিয়োগের বিষয়টা বহুমাত্রিক। রাজার অন্যান্য পারিষদ নিয়োগের ক্ষেত্রে যতটা বেশি বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার প্রয়োজন তার থেকেও অনেকটা বেশি বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন‌ গ্ন গূঢ় পুরুষ নিয়োগের ক্ষেত্রে। মৌর্য যুগে গুপ্তচর শব্দটা সেভাবে ব্যবহার হতো না, গূঢ়পুরুষ হিসেবেই নিয়োগ করা হতো গুপ্তচরদের।

শুধু একবার গুপ্তচর নিয়োগ করলেই রাজার ভূমিকা শেষ হয়ে যেত না, গুপ্তচররা বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে কাজ করছে কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব রাজার। তাই এই বহুমাত্রিক কাজে রাজাকে সাহায্য করতেন মন্ত্রী। ‌ অদ্ভুত ব্যাপার  রাজা ও তার মন্ত্রী মিলে গূঢ়পুরুষ নিয়োগ করলেও এই মন্ত্রী নিজেও কিন্তু গূঢ়পুরুষ নজরবন্দী থাকতেন। সব মিলিয়ে গূঢ়পুরুষ বা গুপ্তচর নিয়োগ একটি জটিল প্রক্রিয়া ছিল সে যুগে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তবে গুপ্তচর নিয়োগ, তার কাজ সবকিছু ইতিহাসের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...