অভয়া রূপে মা দুর্গা তাঁর চার হাতে আশীর্বাদ করেন ভক্তদের

সকালে তখন আকাশে রোদের ঝিলিমিলি। নীল আকাশ, সাদা পেঁজা তুলোর মত মেঘ, আর  দিগন্ত বিস্তৃত একটা মাঠ। অঞ্চলটা না গ্রাম না শহর। নিঃসন্দেহে গঞ্জ বলা যেতে পারে। শহরের ধুলোবালিও যেমন পৌঁছয় না, তেমনি একেবারে গ্রামের ছোঁয়াও জড়িয়ে নেই। হুগলি জেলার বড়গাছিয়া। বড়গাছিয়ার বিখ্যাত পুজো সিংহ বাড়ির দুর্গাপুজো। এই অঞ্চলের ইতিহাস আর পুজোর বয়স একই, প্রায় তিনশো বছর।

আশ্বিনের রোদ আর কাশফুলের শোভা দেখলেই বড়গাছিয়ার চারিদিকে সাজো, সাজো রব ওঠে। ঐতিহ্যবাহী সিংহ বাড়িতে পুজোর গন্ধ লাগে। সাবেকী প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান মিলে সিংহ বাড়ির পুজো যেন কথা বলে। আধুনিকতার ছোঁয়াবিহীন এই পুজো আন্তরিক, সারল্য-মাখানো আর বনেদিয়ানায় পরিপূর্ণ। ১৭৩২ সালে এই পুজোর সূচনা হয়। ‌ স্পষ্ট করে এই পুজোর সূচনাকারীর নাম পাওয়া যায় না। তবে সিংহ বাড়ির কোন পূর্বসূরীর হাত ধরেই এই পুজোর সূচনা। স্থানীয় ভাষায় সিংহ বাড়ির পুজো পরিচিত ‘সিংবাড়ির পুজো’ নামে। শুরুর সময়টাতে গড়পড়তা মাটির আটচালায় পুজো হতো। পরবর্তীকালে পুজোয় আরো খানিকটা রঙ মেশানোর জন্য একটি তিন খিলানের দালান তৈরি করা হয়েছিল। উৎসব পালিত হতো সেই দালানেই। বর্তমানে এটি পাঁচ খিলানের একটি দালান। বজ্রনিরোধক ত্রিশূল সমেত ওম লেখা লোহার গোল চাকতিও রয়েছে যা দালানটির সাজকে পূর্ণ করে। এই দালান ঘিরে রয়েছে গম্বুজাকৃতি শিব মন্দির, রাসমঞ্চ এবং তিনটি দেল পূর্ণিমার মন্দির।

সিংহ বাড়ির পুজোর অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এই পুজোর প্রতিমার হাতের সংখ্যা চার। এখানে দেবী শক্তিরূপী নয়। দেবী এখানে শান্তিদায়িনী। দুর্গা মায়ের রুদ্র মূর্তি প্রকাশ পায় না এখানে। মা এখানে অভয়া। সকল দুঃখ, কষ্ট , দুঃসময় কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করার দিক নির্দেশ করেন। এখানে মহিষাসুর সবুজ রঙের। একসময় জন্মাষ্টমীর দিনে দেবী প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হতো। এখন তা পরিবর্তিত হয়েছে, রথযাত্রার দিন দেবী প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়। এই সিংহ বাড়ির পুজোর সঙ্গে যুক্ত থাকা পরিবারেরা বংশানুক্রমিক ভাবেই এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

পুজোয় রয়েছে বলি প্রথা। আগে মোষ বলি দেওয়া হত , পরে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শুরু হয় ছাগবলি। তবে নবমীতে চাল-কুমড়ো, আখও বলি দেওয়া হয়। সন্ধি পুজোর সময়ে বাড়ির মহিলারা ১০৮টি প্রদীপ বিশিষ্ট দুটি ঝাড়বাতি জ্বালান।

বাড়ির পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য রংবাজনা। নবমীর রাতে ঢাকিরা দীর্ঘক্ষণ ধরে নানান রকম ঢাকের বোল তুলে ও নেচে ঢাক বাজান। একেই বলে রং-বাজনা। উৎসবে অংশগ্রহণ করতে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসেন। প্রতিমা বিসর্জন হয় দশমীর দিনেই।

সিংহ বাড়ির পুজোকে অত্যন্ত জাগ্রত মানা হয়। ওই অঞ্চলের ঐতিহ্য , সংস্কৃতিকে এক সূত্রে বেঁধে রাখে সিংহ বাড়ির দুর্গাপুজো।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...