কলকাতার অন্যতম প্রাচীন মন্দির মা চিতেশ্বরী মন্দির

আজকে আমরা কলকাতার এক প্রাচীনতম মন্দির নিয়ে গল্প করব। কলকাতার অন্যতম প্রাচীন রাস্তার উপর এই মন্দির অবস্থিত। রাস্তাটি হল চিৎপুর রোড; গত শতকে এই এলাকায় ছিল নট্টকোম্পানির দাপট। আজও একে যাত্রাপাড়া বলা হয়। তার আগের শতকে ছিল জন্তু-জানোয়ার আর ডাকাতের দাপট। এমনকি বাঘের উপদ্রবও ছিল। এককালে এই রাস্তার দু-ধারে ছিল ঘন জঙ্গল। আর কলোনিয়াল কলকাতায় বিভাজন ছিল খানিক বেশিই! চৌরঙ্গি, পার্ক স্ট্রিট ছিল বর্ধিষ্ণু ঝা চকচকে হোয়াইট টাউন। চিৎপুর ছিল ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে। 

মোঘল আমলে কলকাতায় একটাও রোড বা চওড়া রাস্তা ছিল না, কেবল একটি মাত্র লেন আর দুটো স্ট্রিট ছিল। চিৎপুর রোড হল কলকাতার প্রাচীনতম রাস্তা, মোঘল আমলেও এর অস্তিত্ব ছিল। ইংরাজ আগমনের অনেক আগে থেকেই চিৎপুরের অস্তিত্ব ছিল, বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের মনসামঙ্গল কাব্যে এবং  মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে চিৎপুরের উল্লেখ আছে। ১৭১৭ সালে সম্রাট ফারুখশিয়ারের সনদে যে ৩৮টি গ্রাম ব্রিটিশদের লিজ দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে চিৎপুরও ছিল।

চিৎপুর থেকে চৌরঙ্গির জঙ্গল পেরিয়ে কালিঘাট পর্যন্ত একটি রাস্তার কথা জানা যায়। যাকে ইংরেজরা ‘রোড টু পিলগ্রিম’ বা 'ওল্ড পিলগ্রিমেজ রোডে' নামে চিনত। রাস্তা দিয়ে কালিঘাট যাওয়া যেত বলেই, পিলগ্রিম কথাটার উদয়। তীর্থক্ষেত্রে যাওয়ার রাস্তা। সবর্ন রায় চৌধুরীরাই এই রাস্তা বানিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। হালিশহর থেকে একবারে বরিশা পর্যন্ত চলে যেত চিৎপুর রোড। এই রাস্তার একদিকে বেন্টিক স্ট্রিট, চৌরঙ্গী স্ট্রিট আর অন্যদিকে চলে গিয়েছে বিটি রোড।

চিৎপুর নামটি কোথা থেকে এল তা জানতে হয় এবার...সেখানেই জড়িয়ে রয়েছে মন্দিরের ইতিহাস। অনেকেই বলে দেবী কালিকা এখানে দুর্গা হয়েছেন। চিত্তেশ্বরী দেবী হরিদ্রাভবর্ণা অর্থাৎ হলুদ রঙের। তবে আর পাঁচটি কালী মূর্তির মতো এই দেবীর রূপ নয়। দেবী এখানে সিংহবাহিনী। রেভারেন্ড লঙ সাহেবের কলকাতা বর্ণনায় এই চিত্তেশ্বরী দেবীর কথাও পাওয়া যায়। লঙ সাহেবের বর্ণনা অনুযায়ী এই মন্দিরে সর্বাধিক নরবলীও দেওয়া হত। আজ আলোর সাজে সেজেছে কলকাতা, কিন্তু এককালে এখানে ছিল আঁধার ঘেরা জঙ্গলাকীর্ণ জনপদ।

সে কলকাতা আজকের ঝাঁ চকচকে শপিং মল, ফ্লাইওভার সম্বলিত কলকাতা নয়, সে কলকাতা ছিল জলাজঙ্গলে পরিপূর্ণ এক অঞ্চল। সেখানেই ছিল মন্দির। কালী মানেই শক্তির আরাধ্যা দেবী, আর কালীপুজো মানেই যুগ যুগ ধরে চলে আসা নানা গা ছমছমে গল্প। সেসব গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন রাজারাজরা থেকে শুরু করে দুর্ধর্ষ সব ডাকাতরা। আর এই সব ডাকাতরা এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় শুধু নয় বরং এক সময় দাপিয়ে বেড়াত খোদ কলকাতার বুকেও।

বর্তমান কলকাতা এক সময় সুন্দরবনেরই একটি অংশ ছিল। জলাজঙ্গলে পূর্ণ এই অঞ্চলে ছিল সুন্দরবনের মতোই বাঘের উপদ্রব আর ছিল ভয়ঙ্কর সব ডাকাতদের উৎপাত। কলকাতার যে অঞ্চল আজ যাত্রা দলের রমরমার জন্য বিখ্যাত সেই চিৎপুরের নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে এক ডাকাত এবং কালী মায়ের নাম। সেই ডাকাতের নাম চিত্তেশ্বর রায় বা চিত্রেশ্বর রায়। এই চিৎপুর নামে কিন্তু কোনও রাস্তা ছিল না সে সময়। এই মন্দিরের পাশ দিয়ে যেতে হত বলে সাহেবরা বলতেন ‘ওল্ড পিলগ্রিমেজ রোড’ বা ‘রোড টু চিৎপুর’। সেখান থেকেই মন্দিরের নাম অনুসারে হয়ে যায় চিৎপুর রোড। আর এই চিৎপুরই ছিল চিতে ডাকাতের আখড়া।

একদিন স্বপ্নাদেশ পেয়ে গঙ্গার জলে ভেসে আসা নিমকাঠ দিয়ে দেবী দুর্গার মূর্তি নির্মাণ করে তা প্রতিষ্ঠা করে চিতু ডাকাত। এবং কালীপুজোর নিয়মানুসারেই শুরু করে পুজো। সে সময় ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত কাশীপুর সংলগ্ন এই অঞ্চলটি ছিল জলাজঙ্গল, এবং গুটি কয়েক জেলেমাঝির বাস। ছিল বাঘের উৎপাতও। ফলে এই মূর্তি তৈরির পাশাপাশি বাঘের উৎপাত থেকে বাঁচতে ব্যাঘ্র দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে সুন্দরবনের প্রতিভূ হিসেবে দেবীর পায়ের কাছে একটি বাঘেরও মূর্তি তৈরি করে চিতে ডাকাত। শোনা যায় প্রতিদিন ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে ষোড়শোপচারে এই মূর্তির পুজো করত চিতে বা চিতু ডাকাত। এই মন্দির আদি চিত্তেশ্বরী মন্দির নামেও খ্যাত কারণ বলা হয় প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো এই মন্দির।

ষোড়শ শতাব্দীতে সম্রাট আকবরের মনসবদার মনোহর ঘোষ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘চিত্তেশ্বরী মন্দির’ থেকে চিৎপুর নামের জন্ম হয়েছে। অন্যমতে চিত্তেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন মহাদেব ঘোষ। জটায়ুর জাস্টিফিকেশনে বলতে হয়, দুর্গার যখন মন্দির মহাদেব করলেও করতে পারেন। ব্ল্যাক জমিন্দার গোবিন্দরাম মিত্র, তার সময়ে এই মন্দির সংস্কার করেছিলেন।

ঐতিহাসিকদের মতে, এই চিত্তেশ্বরী মন্দির সংলগ্ন এলাকাই চিৎপুর এবং মন্দিরে যাওয়ার রাস্তাটি হল চিৎপুর রোড। আবার জনশ্রুতি রয়েছে মন্দিরটির নাম ছিল চিত্রেশ্বরী। ইতিহাস এমনই হয়, কিংবদন্তী আর গপ্পে ঠাসা। যেমন এই মন্দিরকে নিয়ে ডাকাতেরও এক জম্পেশ গল্প আছে।

কাশীপুরে গঙ্গার তীরের চিৎপুরে অবস্থিত এই ‘আদি চিত্তেশ্বরী’ দুর্গামন্দিরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ছিল জঙ্গলে পরিপূর্ণ, এই অঞ্চলে ছিল চিতে বা চিতু ডাকাতের আধিপত্য। কথিত আছে, ভাগীরথী-হুগলি নদীতে ভেসে আসা এক প্রকান্ড নিম গাছের গুঁড়ি দিয়ে চিতে ডাকাতই এই জয়চন্ডী চিত্তেশ্বরী দুর্গা মুর্তি তৈরি করেন। সেখান থেকেই চলে আসে আরেক কিংবাদন্তী, চিতে ডাকাতের আরাধ্য মূর্তির নাম হয় চিত্তেশ্বরী; এই চিত্তেশ্বরী দুর্গার নামানুসারেই এই অঞ্চলের নাম হয় চিৎপুর। এই দুর্গা মূর্তিতেই পুজো দিয়ে ডাকাতেরা ডাকাতি করতে রওনা হত। এটাই আশ্চর্যের ডাকাতরা সাধারণত কালীর আরাধনা করে। কিন্তু এখানেই তারা দুর্গা পুজো করত।

জানা যায়, চিতে ডাকাত এই অঞ্চলে সর্বমঙ্গলা মন্দিরও স্থাপন করেছিল। নরবলিও চলত। এছাড়াও এই অঞ্চলে ছিল সিদ্ধেশ্বরীমদনমোহনের মন্দির

কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে রয়েছে,
'ত্বরায় চলে তরী তিলেক না রহে।
ডাহিনে মহেশ বামে খড়দহ রহে।।
কোন্নগর কোতরঙ্গ এড়াইয়া যায়...
সর্বমঙ্গলার দেঊল দেখিবারে পায়।।
ছাগ মহিশ মেষে পূজিয়া পার্বতী।
কুচিবান এড়াইল সাধু শ্রীপতি।।
ত্বরায় চলিল তরী তিলেক না রয়।
চিৎপুর সালিখা এড়াইয়া যায়।।'

লঙ সাহেবের বর্ণনা অনুযায়ী এই মন্দিরে সর্বাধিক নরবলী দেওয়া হত। সে কারণেই দেবী এখানে দুর্গারূপে পুজিত হলেও এই নরবলীর কারণে কলকাতার নানা ইতিহাসে দেবী কালী রূপেও বর্ণিত হন। অন্যদিকে দক্ষিণ রায় বাঘের মূর্তিটিকে এখানে দেবীর পুজোর আগেই পুজো করা হয়। তবে ডাকাতদের কাছে এই দেবী উগ্রচণ্ডা রূপে পুজিত হলেও বর্তমানে স্নেহময়ী মাতৃরূপেই পুজিত হন। চিতু ডাকাতের মৃত্যুর পর এই বিগ্রহ উদ্ধার করে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই সময়ের জমিদার মনোহর ঘোষ এবং নৃসিংহ ব্রহ্মচারী।

বর্তমানে এই মন্দিরের সেবায়েতের দায়িত্বে রয়েছেন সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বংশধর হালিশহরের কাশীশ্বর এবং ইন্দ্রা রায়চৌধুরী। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের এই মন্দিরে যাতায়াতের উল্লেখ অনেক নথীতেই পাওয়া যায়। তবে এই দেবী দুর্গা হিসেবে পুজিত হলেও এই দেবীর পাশে কিন্তু নেই লক্ষ্মী, গণেশ, সরস্বতী এবং কার্তিক। আজও এই মন্দিরে প্রচুর লোক সমাগম হয়ে থাকে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...