সন্ন্যাস গ্রহণের পর নিমাই সন্ন্যাসী গঙ্গা পেরিয়ে প্রথম পা রাখেন শান্তিপুরে। মানুষ ভেঙ্গে পড়েছিল নবীন সন্ন্যাসীকে দেখতে। এই ভূমেই ছিল তাঁর গুরুগৃহ। চৈতন্যের শিক্ষক অদ্বৈতাচার্যের বাটি। শান্তিপুর তাই অব্যর্থভাবে জড়িয়ে নিমাই সন্ন্যাসীর জীবনের সঙ্গে। যুগ যুগ ধরে হয়ে উঠেছে বৈষ্ণবদের তীর্থক্ষেত্র।
নদীয়া জেলার রানাঘাট সাবডিভিশনের অন্তর্গত জনপদ শান্তিপুর। পূর্বে উত্তর ২৪ পরগণা জেলা। কাছেই ভাগীরথী।
শান্তিপুর নামটি কীভাবে এসেছে তা নিয়ে একাধিক মত পাওয়া যায়। জনশ্রুতি বলে, শান্তামণি, শান্তাপণ বা শান্তাচার্য মুনির নামানুসারে নামকরণ হয় জনপদের। আবার আর একটি মত বলে এখানকার মানুষের শান্তশিষ্ট বিনয়ী স্বভাবের জন্য অঞ্চলের নাম হয়েছে শান্তিপুর।
সুরধনির পাশেই প্রাচীন এই জনপদ আজও মজে আছে কৃষ্ণপ্রেমের ধারায়। শান্তিপুরের বাতাসে ভেসে বেড়াই কৃষ্ণনামের ধ্বনি। সেই ধ্বনিতে মিশে যায় খটাখট তাঁত চলাচলের শব্দ। তাঁতশিল্প শান্তিপুরের অন্যতম পরিচয়। শান্তিপুরের শাড়ি-ধুতির ভুবন জোড়া নাম।
‘চৈতন্যচরিতামৃত’ বলে অদ্বৈতাচার্যের কাছে গোরাচাঁদ দেখা করতে এলে তন্তুবায়রা সমেবত হয়েছিলেন তাঁকে দেখার জন্য। শান্তিপুরে তাঁতশিল্পের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। ১৪০৯ সালের কাছাকাছি সময়ে নদীয়ার রাজা গৌর গণেশ দনু মদনদেবের আমলে তাঁত শিল্পের সূচনা হয়। সেই তাঁতশিল্প ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। বড় আকারে বাণিজ্যিক চেহারা নেয় নদীয়া রাজ রুদ্র রায়ের আমলে।
শান্তিপুরের তাঁতশিল্পের রমরমা প্রঠম ভাঙনের মুখে পড়ে ইংরেজ আমল শুরু হলে। বিলেত থেকে আমদানি করা কলের কাপড় দামে অনেক সস্তা, তার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে বিপদে পড়ে এখানকার তাঁতীরা। একের পর এক তাঁতকুঠি বন্ধ হয়ে যায়।
শান্তিপুরের তাঁতের শাড়ি আর ধুতি বিখ্যাত নকশাদার পাড়ের জন্য। তাঁত শিল্পের পাশাপাশি শান্তিপুরে রেশম ও নীল চাষও হত বহুলভাবে। রেশমকুঠি-নীলকুঠি দুই দেখা যেত এখানে।
শান্তিপুরের বাতাসে কৃষ্ণনাম, সেই টান টেনে আনে বৈষ্ণবভক্তদের। মায়াপুর দর্শনের পথে শান্তিপুর না ঘুরে এলে বৈষ্ণব তীর্থ সম্পূর্ণ হয় না। শান্তিপুরের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বড় গোস্বামী বাড়ি-সহ ২৪টি বিগ্রহবাড়ি। তার মধ্যে ৯টি গোস্বামীবাড়ি বলেই পরিচিত। এখানেই অদ্বৈতাচার্যের সাধনক্ষেত্র অদ্বৈতপীঠ। মূলত তাঁর দৌলতেই শান্তিপুর হয়ে উঠেছিল বৈষ্ণব তীর্থস্থান। শ্রাবণ মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত চলে ঝুলন উৎসব। শান্তিপুরের রাস দেখতে দূর দূর থেকে মানুষ আসে। বড় গোস্বামী বাড়ি, হাটখোলা গোস্বামী বাড়ি, শ্যামচাঁদ মন্দিরে রাস উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান হয়।
এক শহর নানা রসে বিখ্যাত। তার মধ্যে কৃষ্ণপ্রেম যেমন আছে, তেমনি আছে সাহিত্যরস। বহু বিখ্যাত সাহিত্যিক শান্তিপুরের ভূমিসন্তান। তার মধ্যে প্রধান নামটি বাংলা রামায়ণের রচলিতা কৃত্তিবাস ওঝার। শান্তিপুরের ফুলিয়ার বয়রা গ্রামে তাঁর জন্ম। সেই ভিটাতে বসেই তিনি রচনা করেছিলেন রামায়ণ। এছাড়াও সাহিত্যিক দামোদর মুখোপাধ্যায়, কবি করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, বীর আশানন্দ, নাট্যকার অহীন্দ্র চৌধুরী, যোগাচার্য শ্যামসুন্দর গোস্বামীর নাম উল্লেখ করা যায়। অদূরে হরিপুরে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের বাড়ি।
বৈষ্ণব ধর্মের পীঠস্থান এই ভূমি আবার একই সঙ্গে ইসলাম ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের নামের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকা তোপখানার মসজিদ, ঔরঙ্গজেবের সেনাপ্রধান গাজী ইয়ার মহম্মদের তৈরি তোপখানা মসজিদ, সৈয়দ সাহেবের মাজার, ১৭৯৬ সালে তৈরি দানবীর মরহুম শরিবত সাহেবের তৈরি সুদৃশ্য মসজিদ, ওস্তাগর পাড়ার মসজিদ-সহ প্রায় ২৬টি মসজিদ আছে এখানে। প্রতিবছর অত্যন্ত সমারোহের সঙ্গে গাজির বিয়ে।
শৈব এবং শাক্ত সংস্কৃতির অনবদ্য মিশ্রণ ঘটেছে। তাই এখানে একাধিক শিব ও কালী মন্দির। আগমেশ্বরী মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি, গোকুলচাঁদ মন্দির, বংশীধারী শিবমন্দির, সূত্রাগড়ে গণেশ মন্দির, জলেশ্বরের শিবমন্দির, শ্যামচাঁদ মন্দির-এই সব মন্দিরে বারবার তীর্থটানে ছুটে আসেন পুণ্যার্থীরা।