কলকাতার অন্যতম বনেদি বাড়ি হিসেবে মানা হয় এই বাড়িটিকে। পাথুরিয়াঘাটের যদুলাল মল্লিক কলকাতার অন্যতম বনেদি পরিবার মল্লিক বাড়ির সন্তান। পাথুরিয়াঘাটের যদুলাল মল্লিকের ছোট ছেলে মন্মথনাথ মল্লিকের ট্রটিং গাড়ি টানতো একজোড়া জেব্রা। মাত্র ৪৭ বছর আগের ঘটনা। ১৯৩৫ সাল তখন। মল্লিক বাড়িতে আস্থাবলে অনেক ঘোড়া ছিল। মন্মথনাথ মল্লিকের ঘোড়ার গাড়ি ছিল প্রায় ন' রকমের। এতেও মন ভরেনি তাঁর। বৈচিত্র্য আনতেই আলিপুর চিড়িয়াখানা থেকে ৬০০০ টাকায় একজোড়া জেব্রা কিনে তাদের গাড়ি টানার ট্রেনিং দিয়েছিলেন মল্লিক পরিবার। মল্লিক বাড়ির গাড়ি টানত সেই দুই জেব্রা। বনেদি পরিবার মল্লিকদের ছেলে মন্মথনাথ-এর অর্থ, প্রাচুর্যের প্রদর্শনী ছিল বিশাল।। তিনি যখন রোলস রয়েস কেনেন ভারতের রাজা-মহারাজা ও লাট সাহেব ছাড়া আর কারও রোলস রয়েজ ছিল না। ছিল তাঁর নিজস্ব জলযান। মল্লিকা নামে বজরা আর মনোমত নামে মোটর লঞ্চে চড়ে তিনি গঙ্গা বিহার করতেন।
যদুলাল মল্লিকের বড় ছেলে রায় বাহাদুর অনাথ নাথ মল্লিক-এর একমাত্র পুত্র প্রদ্যুম্ন কুমার মল্লিক শৌখিনতার ব্যাপারে বংশের সবাইকে অতিক্রম করেছিলেন। কলকাতার সম্ভ্রান্ত বাড়িগুলি যেকোনো দামে কিনে নিতেন তিনি। এমন অনেক বাড়ি তিনি কিনে নিয়েছিলেন। শোনা যায় টেগোর ক্যাসেল কিনতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁর আবেদন নামঞ্জুর করে দেয়। শুধু বাড়ি-গাড়ি নয়, আভিজাত্যের পরিচয় বহন করা দামী আসবাবপত্র, দুর্লভ শিল্পসামগ্রী কিনতেও পিছপা হতেন না।
৬৭ নম্বর পাথুরিয়া ঘাট স্ট্রিটে যদুলাল মল্লিকের বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও নানা রোমাঞ্চকর ঘটনা। যদুলালের পিতামহ নিমাইচরণ মল্লিক-এর আমল থেকে এই পরিবারের সমৃদ্ধি শুরু হয়। তিনি সেই সময়ের কলকাতায় বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। আইনজ্ঞ ছিলেন। যথেষ্ট দানশীল ছিলেন। মহাজন ব্যাবসায়ী ও সওদাগর নিমাইচরণ অন্য জমিদারদের মতো গ্রামে-গঞ্জে কখনো সম্পত্তি কেনেননি।। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল মধুর। তৃতীয় মহীশূর যুদ্ধের সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে তিনি ৪৮ লক্ষ টাকা ধার দিয়েছিলেন। যুদ্ধে জয়লাভ করে তদানীন্তন বড়লাট লর্ড কর্নওয়ালিস নিমাইচরণকে ইংল্যান্ডের রাজরানীর ছবিসমেত সোনার মেডেল দিয়ে সম্মানিত করেন।
ধনী হলেও নিমাইচরণ ছিলেন পরোপকারী। বহু মানুষকে প্রয়োজনে সাহায্য করেছেন। এমনকী বন্দকী সম্পত্তি ফিরিয়েও দিয়েছেন। মূলত দেশে-বিদেশে ব্যবসা করেই নিমাইচরণ তার অর্থ ও সম্পত্তি বাড়িয়েছিলেন।
আট ছেলে ও দুই মেয়েকে রেখে অল্প বয়সেই মারা যান তিনি। নিমাইচরণ মল্লিক নুনের একচেটিয়া ব্যবসায় প্রায় তিন কোটি টাকা লগ্নি করেছিলেন। আবার এই পরিবারের নাতি যদুলাল মল্লিক ব্রিটিশ সরকারের আরোপিত দেশ ও জাতির পক্ষে ক্ষতিকর লবণ করের বিরুদ্ধে লর্ড ড্যাফরিনের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। নিমাইচরণের পুত্র মতিলাল মল্লিক দত্তক নিয়েছিলেন তার শ্যালিকার একমাত্র পুত্র যদুলালকে। যদুলাল মল্লিকের ৬৭ নম্বর পাথুরিয়া ঘাট স্ট্রিটের বাড়িতে ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ,,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্রমূখ বাংলার পরম পূজনীয় ব্যক্তিরা যাতায়াত করতেন। পাথুরিয়াঘাটের বাড়ির সিংহবাহিনী ঠাকুরদালানে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের একবার ভাব সমাধি হয়েছিল। নিমাই চরণের প্রথম পুত্র ও রামগোপাল মল্লিক সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে রাজা রামমোহন রাধাকান্ত দেব বাহাদুরএর মত কলকাতার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে দরবার করেছিলেন। এই মল্লিক পরিবার কলকাতার অনেক হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ তৈরিতে বহু অর্থ দান করেছেন। কলকাতাকে বসবাসযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য ।
মল্লিক পরিবার সংস্কৃতি চর্চাতেও পিছিয়ে ছিলেন না। প্রায় লুপ্ত আঁকড়াই গানের আসর বসত যদুলালের বাড়িতে। কবির লড়াই হতো। আবার নর্তকিনী ও বাইজি নেচেছেন মতিলাল মল্লিকের বাগান বাড়িতে।
৬৭ নম্বর পাথুরিয়া ঘাট স্ট্রিট এর বাড়িতে এখনো থাকেন যদুলাল মল্লিকের ছোট ছেলে মন্মথনাথ এর পরিবার। দোতলা বাড়ি। বাড়ির মাঝখানেই খোলা উঠোন ও চারপাশে বারান্দা। রয়েছে ঠাকুরদালান। বেসমেন্টেও কিছু ঘর আছে যেগুলো এখনো বাড়ির পরিচালকরা ব্যবহার করেন। মূল বাসিন্দারা থাকেন বাড়ির অন্দরমহলে।
কলকাতার উত্তরে আপাত-নিরিবিলি ও সংকীর্ণ একটা রাস্তা পাথুরিয়া ঘাট স্ট্রিট। এই রাস্তায় আজও জ্বলজ্বল করছে পাথুরিয়া ঘাট স্ট্রিটের মল্লিক বাড়ি।
তথ্যসূত্র:- বনেদি
কলকাতার ঘরবাড়ি:- দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়