উত্তরবঙ্গের এই লৌকিক দেবীকে পুজো না করলে জেলেরা মাছ ধরতে পারত না

উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার ময়নাগুড়ি থেকে ভোটপট্টি গিয়ে সেখান থেকে হেলাপাকরি যাওয়ার পথে জল ট্যাঙ্কের মোড়। জল ট্যাঙ্কি থেকে কিছুটা এগোলেই খয়ের খাল গ্রাম। খয়ের খাল গ্রামের একটা এলাকার নাম অর্জুনের বাড়ি। মনে করা হয় বহু আগে হয়তো অর্জুন নামে কেউ এই অঞ্চলে থাকতো। তার নামকরণেই অঞ্চলের নাম হয়েছিল অর্জুনের বাড়ি। এই এলাকায় সানিয়াজান নদীর একটি শাখা প্রবাহিত হয়েছে। এই অঞ্চলের নদীর স্রোত কমে গিয়ে সেখানে তৈরি হয়েছে বিল। এই বিলের ধারেই রয়েছে পাগলি দেবীর থান। সবুজের মাঝে মনোরম জায়গা। এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া সরু আলপথ, এক পাশে সবুজ ক্ষেত। এরপর রয়েছে বাঁশ গাছের জঙ্গল। বাঁশ বনের পাশে দুটো সিমেন্ট বাঁধাই করা খোলাঘর রয়েছে। তিন পাশে দেওয়াল, মুখটা খোলা। ওপরে টিনের চাল। এখানেই রাখা রয়েছে বিল পাগলী দেবীর মূর্তি। অন্য আরেকটি ঘরে রয়েছে সন্ন্যাসী ঠাকুর আর পেত্তানীর মূর্তি। এর পাশে বৃন্দাবনী দেবীর সান বাঁধাই করা থান।

এই দেবীর নাম বিল পাগলি হল কেন? তাই নিয়ে রয়েছে অনেক মজার তথ্য। এই থানের কাছে যে ছোট্ট বিলটি রয়েছে সেখানে নাকি প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। মাছ এই বিল পাগলি দেবীর খুব প্রিয় ছিল, পাগলী দেবীকে পুজো না করে কেউ এই মাছ ধরতে এলেই নানা উপদ্রব সহ্য করতে হতো। আর নিয়ম মাফিক পুজো পেলেই বিলপাগলী দেবী শান্ত হয়ে মাছ ধরায় আর কোন উপদ্রব করতেন না। এমন জনশ্রুতি আছে বিল পাগলি নাকি একেবারে পাগলের বেশে স্থানীয় অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত। এই বাড়ি দুটির গৃহকর্তা বিল পাগলীকে পুজো দিয়ে প্রথমবার শান্ত করে। বিল পাগলীর পুজোর থানের পাশেই রয়েছে সন্ন্যাসী ঠাকুর আর পেত্তানীর থান। একসঙ্গে পুজো দিতে হয়। স্থানীয় মানুষরা আজও বিল পাগলী এবং এই সন্ন্যাসী ঠাকুরকে মানে। অনেকে মানত করেন এখানে। বর্ষার আগে জৈষ্ঠ্য মাসে যখন আমন ধানের চাষ হয় তখন একটা দিন দেখে বিল পাগলী সন্ন্যাসী ঠাকুর আর পেত্তানীকে একসঙ্গে পুজো দেওয়া হয়। পুজোর দায়িত্বে থাকেন রাজবংশী মাড়েয়া। খুব সাধারন কিছু নৈবেদ্য যেমন দুধ, আতপ চাল, কলা, দই, আমন ধানের চিড়া, ফলমূল এসব দিয়েই পুজো দেওয়া হয়। পাঁঠা বা খাসির বলি দেওয়ার প্রথাও রয়েছে এই পুজোয়। সন্ন্যাসী ঠাকুরকে এক ছিলিম গাঁজা কল্কের মধ্যে ভরে উনুনের আঁচে কিছুক্ষণ গরম করে সেটা উৎসর্গ করা হয়।

এই পেত্তানী দেবী নাকি যে কোনও ব্যক্তির উপর ভর করতে পারে, নিষ্ঠা ভরে পূজো না করলে দেবী পেত্তানী ক্ষেপে যায়, এমনটাই জনশ্রুতি। তখন পেত্তানী উক্ত ব্যক্তিকে আক্রমণ করে এবং তাকে পাগলের মত ব্যবহার করতে বাধ্য করে।

বিল পাগলী দেবীর মূর্তিটা অন্যরকম দেখতে। এক মহিলার অবয়ব। পরনে নীল শাড়ি। শাড়ির মধ্যে চকচক করছে সোনালী ডিজাইন। কপালে লাল টিপ। গলায় তিনটে লাল দাগ থাকে। সমস্ত গায়ে গয়না পরা, হাতে চুড়ি ও কানে লম্বা দুল। একেবারে আটপৌরে, ঘরোয়া ভাবেই পুজো দেওয়া হয় এই লৌকিক দেবীদের। পুজোর উপচার এবং মন্ত্রের দিক থেকে এরা একেবারে ঘরের মেয়ে হয়ে উঠেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...