পল্লী বাংলায় কালী নানান নাম পেয়েছেন। চিরাচরিত শ্মশান কালী, সিদ্ধেশ্বরী কালী, ভাবতারিণী কালী, ক্ষ্যাপা কালী, রক্ষা কালী নামের বদলে প্রান্তিক বাংলায় কালী হয়ে উঠেছেন কোথাও মামলা কালী, কোথাও আবার ফটক কালী, সার্ভিস কালী নামেও পরিচিতি পেয়েছেন দেবী। তেমনই মেদিনীপুরে দেবী হয়েছেন মা মোটা কালী। মেদিনীপুর শহরের মানিকপুর ভ্রাতৃসংঘের মোটা কালীর পুজো দেখতে প্রতি বছরই ভিড় জমান ভক্তরা। পুজোর বয়স প্রায় ষাট বছর।
পশ্চিম মেদিনীপুরের মেদিনীপুর শহরের মানিকপুরের গোলঞ্চতলা মাঠে মা মোটা কালীর পুজো হয়। দেবীর মূর্তি অতিকায়। এখানে প্রায় ২১ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট প্রতিমার পুজো হয়। জনশ্রুতি রয়েছে, অবিভক্ত মেদিনীপুরের কুস্তিগীরেরা এই দেবী কালিকার পুজো আরম্ভ করেছিলেন। দেবী মূর্তি বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী। তাই ভক্তদের কাছে মা কালীর নাম মোটা কালী। অন্য একটি মতে, মানিকপুরে বৃহৎ বড় আকারের কালী তৈরি করে পুজো করা হয়। সে কারণেই নাম হয়ে গিয়েছে মোটা কালী। মেদিনীপুরের ঐতিহ্য হয়ে গিয়েছেন ‘মোটা কালী’ বা ‘বড় কালী’।
দেবীর গাত্রবর্ণ অমাবস্যার তিমির রাতের মতো কালো। দেবী চতুর্ভুজা। তাঁর হাতে থাকে মুণ্ড, খড়্গ। তিনি বরাভয় ও আশীর্বাদ দান করেন অন্য দুই হাতে। দেবীর পায়ের নীচে থাকেন দেবাদিদেব মহাদেব। মা মোটা কালীর চূড়ায় থাকে তীরের মুকুট থাকে। গঙ্গারিডি সভ্যতায় মাতৃ মূর্তিতে এমন মুকুট দেখা যেত।
গরুর গাড়ির উপরে তৈরি হয় প্রতিমা। লোক মুখে শোনা যায়, আজ থেকে ৫৬ বছর আগে এলাকার কয়েকজন যুবক মিলে কালীপুজো করার উদ্যোগ নেন। এক মাস ধরে পেল্লায় আকারের প্রতিমা গড়েন ওই যুবকদের দল। প্রতিমার এমন অতিকায় আকার দেখে সকলের তাক লেগে যায়। বিশাল উচ্চতার প্রতিমা রীতিমতো বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। তখন থেকেই কালীর নাম হয় মোটা কালী। এত বড় প্রতিমা বিসর্জনের ক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা দেয়। তখন থেকে গরুর গাড়ির উপরেই প্রতিমা তৈরি করা হয়। পুজো শেষ হলে নিরঞ্জনের উদ্দেশে গরুর গাড়ি টেনে নিয়ে যাওয়া হয় নদীঘাটে। প্রতিমার বিসর্জনের দিন রাস্তার দুই ধারে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে থেকে দেবীর আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন।
দেবীর মোটা কালী নামের নেপথ্যে রয়েছে এক কাহিনি। বহু বছর আগে মেদিনীপুর শহরেই এই অঞ্চলে ছিল শরীর চর্চার কেন্দ্র বা আখড়া। অনেকেই শরীরচর্চা করতে আখড়ায় আসতেন। ঘরে ঘরে শরীরচর্চা, শারীরিক কসরৎ করার চলও ছিল। তখনই বিশাল আকারের কালী প্রতিমা গড়ে পুজো করা শুরু হয়। পুজোর দিনগুলিতে একদা শরীর চর্চার প্রতিযোগিতাও হতো। কালের নিয়মে সে পাঠ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আখড়াগুলিও হারিয়ে গিয়েছে। তবে পুজো আজও চলছে।