বজবজের বাওয়ালি। কলকাতার অনতিদূরে এই অবস্থিত এই বাওয়ালি। ৮০/১ বি টালিগঞ্জ রোডের একটা পুরনো বাড়ির অন্দরমহলের বৈঠকখানায় রয়েছে একটা ঐতিহ্যবাহী কাঠের সিঁদুরকৌটো। এই সিঁদুরকৌটো আসলে মন্ডল পরিবারের স্ত্রী সহমৃতা হওয়ার পরের সিঁদুর। সহমিতা মেয়েটির শাঁখারও অংশ রয়েছে এই বাড়িতে। ১২২৩ বাংলা সনে কৃষ্ণ একাদশীর দিন টালিগঞ্জের বর্তমান দ্বাদশ মন্দিরের মাঝখানে সাজানো চিতায় মানিক মন্ডলের স্ত্রী মুক্তকেশী সহমরণে গিয়েছিলেন। সেই মুক্তকেশীর শাখা-সিঁদুর এখনো টালিগঞ্জ ও বাওয়ালি গ্রামের মন্ডলদের অনেকের বাড়িতে রাখা রয়েছে। এই শাঁখাকে বলে আগুনখাঁকির শাখা। এটি অত্যন্ত পবিত্র জিনিস বলে মানা হয়।
এটা সেই সময়ের কথা তখন বাংলায় প্রবল ভাবে বহাল রয়েছে সতীদাহ প্রথা। স্বামীর মৃত্যুর পর কেউ সতী হচ্ছেন শুনলে তখনকার দিনে সধবারা তার হাতে পরিয়ে দিতেন শাঁখা, মাথায় দিতেন সিঁদুর। তারপর ওই শাঁখা-সিঁদুর পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সংগ্রহ করে নিতেন। এত সধবা এসে শাঁখা পরাতেন যে সতীর দুহাতের কব্জি থেকে বাহু পর্যন্ত শাখার শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ত। দূরে মাথার চুল লাল হয়ে যেত। শোনা যায় পুরোহিত লাঠি দিয়ে সহমৃতার সেই হাতের শাঁখা ভেঙে দিতেন। সেই ভাঙা শাঁখার টুকরো সংগ্রহ করার জন্য বাড়ির বউদের রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। বাওয়ালির মন্ডল পরিবারের উত্তরসূরীদের অনেকের বাড়ি রয়েছে টালিগঞ্জেও। সেখানেও রয়েছে সহমৃতা মেয়ের সিঁদুর ও শাখার টুকরো। নিষ্ঠুর অতীতের সাক্ষ্য হিসেবে রয়েছে এই সতীর শাঁখা ও সিঁদুর।
টালিগঞ্জের মন্ডলদের বাওয়ালির মন্ডল হিসেবেই অনেকে চেনেন। এখনো টালিগঞ্জের একটি রাস্তার নাম বাওয়ালি মন্ডল রোড। কলকাতার চেতলায় রয়েছে মন্ডল টেম্পেল লেন। এসবই বাওয়ালির মন্ডলদের পরিচয় বহন করে।কলকাতা থেকে তেমন একটা দূরে নয় বাওয়ালি গ্রাম। সমস্ত গ্রাম জুড়েই রয়েছে মন্ডলদের অতীতের সমৃদ্ধির চিহ্ন। মন্ডলদের বাড়িতে রয়েছে একটি কাঠের ব্রিজ। গ্রামের মানুষের কাছে এর নাম জলটুঙ্গি বাগান। শোনা যায় এদের নিজস্ব চিড়িয়াখানাও ছিল। মডেল পরিবার নিজেদের তৈরি লাইব্রেরীর নাম দিয়েছিলেন হুইম্সিকাল ক্লাব।বাওয়ালি থেকে টালিগঞ্জ এর দূরত্ব বেশি নয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সমগ্র অংশই ছিল তাঁদের জমিদারি। চেতলা, আলিপুর, টালিগঞ্জ থেকে গঙ্গাসাগর, কাকদ্বীপ পর্যন্ত হাজার হাজার একর সম্পত্তি ছিল এঁদের।
বাওয়ালির মণ্ডলরা ছিলেন মাহিষ্য। যতদূর জানা যায় এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন বাসুদেব রাম। তার ছেলে রাধাশ্যাম। রাধাশ্যামের ছেলে শোভারাম হিজলি রাজ সরকারের অধীনে পাটোয়ারীর কাজ করে বজবজের অন্তর্গত চন্ডিপুর গ্রামে মন্ডল এর পদ পেয়েছিলেন। এই শোভারামের ছেলে মেঘনাথ। মেঘনাথের ছেলে রাজারাম। নবাব সরকারের কর্মচারী ছিলেন ইনি। মুঘল সম্রাট শাহজাহান বা ঔরঙ্গজেবের আমলে বাংলার কোন এক জায়গায় বিদ্রোহ দমনে তিনি সম্রাটকে বিশেষ সাহায্য করেছিলেন। পুরস্কার স্বরূপ মুঘল সম্রাট তাকে দিয়েছিল সনদ। এর ফলে তিনি বজবজ বাওয়ালি, কালীনগর সাহেবানবাগের অন্তর্গত চকমানিক-এর মত জায়গার মন্ডল হয়েছিলেন। রাজারাম মন্ডলের ছোট ছেলে মানিক মন্ডলের সময় থেকে এই মন্ডল পরিবারের আসল সমৃদ্ধি শুরু হয়। তাই তার সময়ে বাওয়ালিতে বর্গীরা হামলা করেছিল। রুখতে সক্ষম হয়েছিলেন মানিক মন্ডল। এই মানিক মন্ডল এর স্ত্রী মুক্ত কেশী স্বামীর সঙ্গে সহমরণে গিয়েছিলেন।
মানিক মন্ডলের পাঁচ ছেলে। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র উদয়নারায়ণ টালিগঞ্জের বিখ্যাত ঝুলন উৎসবের সূচনা করেছিলেন। টালিগঞ্জের বড় রাজবাড়ীর প্রতিষ্ঠাতা উদয়নারায়ণ ছিলেন। টালিগঞ্জ রোডেই ছিল মন্ডলদের জমজমাট বসতবাড়ি ও কাছারি বাড়ি। নানা শরিকের ভাগ বাটোয়ারায় আজ তার আসল চেহারা হারিয়ে গেছে। টালিগঞ্জের এই মন্ডলদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল রানী রাসমনির পরিবারের। রানী রাসমণিদের বলা হত মাঢ়-বাড়ী। মন্ডলদের বংশধররা টালিগঞ্জ এবং বাওয়ালিতে এখনো রয়েছেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাঁদের বনেদিয়ানা, সমৃদ্ধি আজও বনেদি কলকাতার ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল অধ্যায়।