এই বাড়িটিকেই ‘রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ি’ বলে চেনে আমহার্স্ট স্ট্রিটের মানুষ

“দিস হাউস ওয়াজ দ্য ফ্যামিলি রেসিডেন্স অফ রাজা রামমোহন রায়, ফাউন্ডার অফ দ্য ব্রাহ্ম সমাজ। বর্ন ১৭৭২, ডায়েড ১৮৩৩।” বাড়িটার গায়ে লেখাগুলো মলিন হয়ে গেছে। তবুও আমহার্স্ট স্ট্রিটের এই বাড়িটিকেই রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ি বলে চেনে এই অঞ্চলের মানুষরা। এই বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই চোখে পড়ে দোতলার কিছু অংশের ধ্বংসাবশেষ। জানালা, দরজাবিহীন বড় বড় ঘর। বাড়িটা রীতিমতো খাঁ খাঁ করছে। রক্ষণাবেক্ষণ-এর অভাবে মেঝের মার্বেল, টালিগুলিও প্রায় অদৃশ্য। বাড়ির এখানে-ওখানে জমে রয়েছে জঞ্জাল। বাড়ির ছাদে, পেছনের কার্নিশে বেপরোয়া অশ্বত্থ গাছের দৌরাত্ম্য । পায়রাদের বকম বকম ডাক। ৮৫ নম্বর আর্মহার্স্ট স্ট্রিটের এর বাড়িটার অস্তিত্ব বলতে আপাতত এটাই। যদিও ও গাঁথুনির দিক থেকে বাড়িটা যথেষ্ট শক্তপোক্ত। কিন্তু নূন্যতম রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই বাড়ির অবস্থা শোচনীয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালির অন্যতম সেরা সমাজ সংস্কারকের বাড়ি রীতিমতো অপেক্ষমান, জীর্ণ, যেন কোন সহৃদয় মানুষের অপেক্ষায় রয়েছে। কেউ এসে রক্ষা করবে বাড়িটি, সে দিন গুনছে।

 

rammohan

 

৮৫ নম্বর আর্মহার্স্ট স্ট্রিটের এই বাড়িটি দক্ষিণমুখী। বিশাল দোতলা বাড়ি। বাড়িটির ভেতরে রয়েছে একটি পুকুর। কচুরিপানায় ভরা। বাড়িটির আশপাশের অঞ্চল যথেষ্ট অপরিচ্ছন্ন। একদিকে ছোট কারখানা। অথচ এই বাড়ি একসময় কলকাতার অন্যতম বনেদি বাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল। বাড়িতে সিলিং সাজানো হয়েছিল ছাঁচে তৈরি অলংকৃত টিন শিট দিয়ে।

 

পুকুরঘাটে যাওয়ার জন্য বাড়িটির পূর্ব দিকের দেওয়ালে রাখা হয়েছিল একটি দরজা। দরজাটি যে দীর্ঘদিন খোলা হয় না তা দেখলেই বোঝা যায়। এই বাড়ির প্রধান দরজাটি লোহার যাকে আমরা ফটক বলি। দুপাশে ছটি থাম একে ঘিরে রেখেছে। এই গাড়ি-বারান্দা ও বাড়িটিকে বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যাবে না ভেতরে এর অবস্থা কতটা জীর্ণ।

 

এই বাড়িতে নাকি থাকতেন রামমোহন রায়, সে কথা শ্বেত পাথরের ফলকে লেখা থাকলেও বাড়ির মালিকানা নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে রয়েছে কিছু বিতর্ক। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত রামমোহন রায় পুস্তিকায় “লিখেছেন ১৮১৪ সালে রামমোহনের দুটি বাড়ি কেনা হয়েছিল, উহার প্রথমটি চৌরঙ্গীতে অবস্থিত বড় হাতা সংযুক্ত একটি দোতলা বাড়ি। ২০৩১৭ টাকায় এলিজাবেথ পেনভিক নামে এক ব‍্যবসায়ীর নিকট হইতে বাড়িটি কেনা হয়। দ্বিতীয় বাড়িটি মানিক তলায়। উহা ১৩০০০ টাকায় ফ্রান্সিস মেনডেস নামে এক সাহেবের নিকট হইতে কেনা। এই সময়েই সম্ভবত জোড়াসাঁকোতে তাহার যে বাড়িটি ছিল উহা বিক্রয় করিয়া ফেলা হয়।" ৮৫ নম্বর আমহার্রস্ট স্ট্রিটের  বাড়িটির উল্লেখ কিন্তু কোথাও নেই। আনন্দমোহন চট্টোপাধ্যায়ের মতে আমহার্স্ট স্ট্রিটের এই বাড়িটি রাজা রামমোহন রায় কেনেননি বা তৈরিও করেননি। এটি আসলে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র উকিল রমাপ্রসাদ রায়ের তৈরি বাড়ি। অথচ এই বাড়ির গায়ের শ্বেত পাথরের তৈরী স্মৃতি ফলকে রামমোহন রায়ের নাম লেখা।  

 

রামমোহন রায়ের জীবনীকার কুমারী সোফিয়া কোলেত বিশ্বাস করতেন, এই বাড়িটি ছিল রামমোহন রায়ের। আবার রাধারমণ মিত্রের গবেষণামতে এই বাড়িটি রামমোহনের সরাসরি তৈরি নয়। অর্থাৎ বসতবাড়িটি কার এ নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। কিন্তু স্থানীয় মানুষরা বিশ্বাস করেন ৮৫ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়ি আসলে যা মোহন রায়ের বাড়ি। এই বাড়িতে নাকি অজস্র স্মৃতি রয়েছে তাঁর। সব মিলিয়ে কলকাতার এই বনেদি বাড়ির মালিকানা যে কার তা নিয়ে রয়েছে ধন্দ। তবে কলকাতার বুকে এই বাড়ির অস্তিত্ব আজও উজ্জ্বল।

 

তথ‍্যসূত্রঃ-১. ক‍্যালকাটা থেকে কলকাতাঃ- গৌতম বসু মল্লিক

 

২. বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি- দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...