দুয়ারী দত্তের বনেদি বাড়ি ও বিলিতি ব্যবসার গল্প!

দ্বারিকানাথ দত্ত। ঠনঠনে দত্ত বাড়ির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। প্রথমে এদের বাড়ি ছিল কলুটোলা লেনে। উত্তর কলকাতার বাড়ি ছেড়ে একটি বিরাট বাড়ি কিনেছিলেন দ্বারিকানাথ দত্ত। ঠিকানা তিন নম্বর কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট। এই বাড়ির পূর্ব দিকে ছিল পুকুর। পুকুর বুজিয়ে সেখানে তৈরি করা হয় অন্দরমহল। মূল বাড়িটি কলকাতার অন্যতম ঐতিহ্যশালী বাড়ি হয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট ছিল না। কিন্তু এই বাড়িটি সংস্কার করে তাকে কলকাতার অন্যতম বনেদী বাড়ি করে তুলেছিলেন দ্বারিকানা দত্ত। এখানে ঠাকুরদালান, নাচঘর ইত্যাদি সংযোজন করেন। সংযোগস্থলে একটি জমি কিনে সেখানে তিনি একটি প্রাসাদ তৈরি করেন।

 

এই দ্বারিকা নাথ দত্ত কে? বিভিন্ন ব্রিটিশ কোম্পানির বেনিয়ান এবং মুৎসুদ্দি হয়ে সাহেব আমলে অর্থ উপার্জন করেছিলেন বহু বাঙালি ব্যবসায়ী। কলকাতার অনেক বনেদি পরিবার এভাবে অঢেল অর্থ উপার্জন করেছেন। ‌ ঠনঠনে দত্তবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা দ্বারিকানাথ দত্ত জার্ডিন এন্ড স্কিনারের সামান্য বেতনের কেরানী থেকে কোম্পানির বেনিয়ান হয়েছিলেন। ঠনঠনের দত্ত বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা দ্বারিকানাথ দত্ত নিজের কর্মদক্ষতায় ইংরেজদের অত্যন্ত কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। ব্যবসায় তাঁর প্রখর বুদ্ধি ছিল। একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলেছিলেন যার প্রধান কাজ ছিল ম্যানচেস্টার লাঙ্কাশায়ার প্রভৃতি জায়গা থেকে নানা ধরনের কাপড় আমদানি করা। ‌ দেশীয় বস্ত্রশিল্পের ক্ষতি হয় এতে। বহু তন্তুবায় কাজ হারান। কিন্তু দ্বারিকানাথ দত্তের মত মানুষরা লাভবান হয়েছেন।

 

দ্বারিকানাথের কোম্পানির অফিস ছিল আজকের বিবাদী বাগ এলাকার ৬ নম্বর স্ট্রিটের বাড়িটিতে। তার আমদানি করা সিল্ক ফিনিশট টুয়েল, টার্কিশ রেড ক্লথ কলকাতায় অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।

 

দ্বারিকানাথ দত্তের পরিবারের সঙ্গে ব্যবসার যোগাযোগ ছিল বড় গভীর। তাঁর পূর্বপুরুষ অনুপম দত্তের তুলো এবং সুতোর ব্যবসা ছিল। শেঠ, বসাক লাহাদের মত তিনিও সপ্তগ্রামে ব্যবসাপত্র চালাতেন। ‌ সরস্বতী নদীর মৃত্যু তাঁকে ভাগ্য অন্বেষণে যেতে বাধ্য করে। শ্রীরামপুরে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এই পরিবারের উদ্দেশ্যটি দ্বারিকা নাথ দত্ত। তাঁর বাবা কলুটোলা অঞ্চলে বাড়ি কিনেছিলেন। দ্বারিকা নাথের চার সন্তান ছিল। ব্যবসাপত্র বৃদ্ধি হয়েছিল তার সময়ে। তিনি তখন কলুটোলার বাড়ি ছেড়ে ঠনঠনে অঞ্চলের তিন নম্বর কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের বাড়িটি কেনেন।

 

ব্যবসা করে যে টাকা রোজগার করেছিলেন তাই দিয়ে জমিদারি কিনতে দেরি হয়নি দ্বারিকানাথের। মেদিনীপুরে বিশাল জমিদারি ছিল তার। ‌ পরবর্তীকালে ব্যারাকপুরের গঙ্গার ধারে বাগানবাড়িতে এবং কলকাতায় ৩০টি বাড়ির মালিক হয়েছিলেন তিনি।

 

তিনি পরবর্তীকালে দুর্গাপূজা শুরু করেন। ১৮৫৫ সাল থেকে এই পুজো চলে আসছে। বৈষ্ণব মতে এই পুজো সম্পন্ন হয়। পুজোয় যাত্রা, নাচ, গান এসবের প্রচলন ছিল। বারান্দায় বসে তাদের বাড়ির মেয়েরা নাচ গান দেখতেন। এই বারান্দাকে নাচ বারান্দা বা যাত্রা দেখার বারান্দা বলা হতো। তাদের পরিবার রক্ষণশীল ছিল। মাঝখানের আসরে আমন্ত্রিত অতিথিরা কাঠের ঝিলমিল থাকায় বাড়ির মেয়েদের দেখতে পেতেন না। এভাবে রক্ষণশীল পরিবারের আদব-কায়দাও বজায় থাকতো।

 

দ্বারিকানাথের ডাকনাম ছিল ‘দুয়ারী’। স্থানীয় মানুষরা তাঁর বাড়িটিকে বলেন ‘দুয়ারী দত্তের বাড়ি’। এই বাড়িটিতেও হাজারদুয়ারির মতো নাকি হাজারখানেক দরজা আছে। যদিও এর সত্যতা নিয়ে রয়েছে প্রমাণের অভাব। দ্বারিকা নাথের অর্থ ও প্রতিষ্ঠাতা তেমন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। শেষ জীবনে জাহাজ ডুবির ফলে তাকে অনেক ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল। তাঁর কেনা বিলিতি কাপড়-চোপড় অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য আসছিল এই জাহাজে। এরপর আর অল্পদিনে বেঁচেছিলেন তিনি। এই পরিবারেও রয়েছে দেবত্ব সম্পত্তি। ব্যবসা দিয়ে শুরু হলেও এই পরিবারের উত্তরসূরীরা ব্যবসাকে আঁকড়ে ধরে থাকেননি। অনেকে চাকরিতে গেছেন। তবুও কলকাতার বনেদি বাড়ির স্মৃতির ঝুলিতে দ্বারিকানাথ দত্তের বাড়ি একটা অন্যতম স্থান করে নিয়েছে।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...