চোরবাগানের মিত্রবাড়ির ৩৩০ বছরের কালীপুজোয় এসেছিলেন লর্ড ক্লাইভ

এ সখের বাজার বেহালার সখের বাজার নয়। উত্তর কলকাতার একটি অঞ্চলের নাম ছিল সখের বাজার। মুক্তারামবাবু স্ট্রিট অঞ্চলে। এখানেই বহু গঙ্গাস্নানার্থীদের লুটপাট করে নিত একদল চোর-ডাকাত। লোকমুখে জায়গাটির নাম হয়ে গেল ‘চোরবাগান’। হারিয়ে গেল ‘সখের বাজার’ নাম। কালে কালে মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের চোরবাগান অঞ্চল বিখ্যাত হয়ে উঠল বনেদি পরিবারের তৈরি বাড়িতে। শুধু এমন বর্ধিষ্ণু অঞ্চলের নাম চোরবাগান থেকে গেল।

 

চিত্তরঞ্জন অ‍্যাভিনিউ দিয়ে মুক্তারামবাবুস্ট্রিটে ঢুকে কয়েক পা এগোলেই ডানদিকে পড়ে মিত্র বাড়ি। এই বাড়িরই রামরাম মিত্র ছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাবের দেওয়ান। এই দেওয়ানি করেই প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন রামরাম মিত্র। তাঁদের আদি বাড়ি কোন্নগর। তবে ব্যবসা সূত্রে চলে আসেন কলকাতা। তখন যদিও কলকাতার নাম ছিল গোবিন্দপুর। ব্যবসায় অর্থ উপার্জন করতে থাকেন তাঁরা। তাঁর ছেলে অযোধ্যারাম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গোবিন্দপুরে কেল্লার জন্য জমি নিলে অযোধ্যারাম চলে আসেন মেছুয়াবাজারে। ‌ তার দুই ছেলে কৃপারাম ও জগন্নাথ। কৃপারাম বিষয়-সম্পত্তি, ভাগ-বাটোওয়ারার পরে চলে যান বেলেঘাটায়। জগন্নাথ থেকে যান পৈত্রিক বাড়িতেই। রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র কৃপারামের বংশধর।

 

প্রায় ৩৫০ বছরের পুরনো এই পরিবারের চোরবাগানের বাড়িটি করেছিলেন জগন্নাথের ছেলে রামসুন্দর মিত্র। ভূমিকম্পে এই বাড়ির কিছুটা অংশ ভেঙে যাওয়ায় ম্যাকিনটশ বার্নকে দিয়ে বাড়ির খোলনলচে বদলে ফেলা হয়। প্রায় পাঁচ বিঘা জমির উপর এই চোর বাগানের মিত্র বাড়ি। ছয়টি থাম রয়েছে বাড়িটিতে।। ছ’টি থাম বাড়ির সামনের অংশকে গ্রিক স্থাপত্যের চেহারা দিয়েছে। এছাড়াও বাড়িতে রয়েছে পোর্টিকো। মিত্র লেনের প্রবেশপথে চারটি থাম ও পোর্টিকো এরই বিস্তৃত  রূপ। দরবারঘর, জলসাঘর, গোমস্তাখানা ঠাকুরদালান ইত্যাদি নিয়ে এই বাড়িটি আগে ছিল দোতলা। পরবর্তীকালে তিনতলা করা হয়েছিল। ‌বহু প্রজন্ম ধরে মিত্ররা এই বাড়িতে থেকেছেন এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন। সাবেক অন্দরমহলে খিলান দেওয়া সিঁড়ি একতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। ম‍্যাকিনটশ বার্ন সিঁড়িটিকে তিনতলায় পৌঁছে দিয়েছেন এবং তা করতে গিয়ে পুরনো খিলান রীতিটিকেই বজায় রেখেছেন। কয়েকটি ঘরের মেঝেয় রংবেরঙের কাচ বসানো। ‌ দেওয়ালে সাহেব শিল্পীদের আঁকা বড় বড় তৈলচিত্র। এই বাড়িতে চীনের মিং আমলের নানা আকারের পোর্সেলিন ফুলদানি, ঝাড়লন্ঠন, অ্যান্টিক আসবাবপত্র রয়েছে। মার্বেল পাথরের মূর্তিও রয়েছে। ১৪২৮ এডি মিং ডাইনেস্টি। বর্তমান বংশধরেরা উত্তরাধিকার সূত্রে এই এই শিল্প সামগ্রীগুলি পেয়েছেন। তবে এই বাড়িটিতে কোন লাইব্রেরী নেই। পুঁথি বা বই পড়ার অভ্যেস সেভাবে ছিল না।

 

রামসুন্দর মিত্রের মহাজনি কারবার ছিল। এই ব্যবসার মাধ্যমে প্রচুর টাকা উপার্জন করেছিলেন তিনি। লর্ড ক্লাইভকে দৈনিক সুদে টাকা ধার দিতেন। কলকাতার বহু বনেদি পরিবার ইংরেজদের ব্যাংকার হিসেবে কাজ করেছেন। তার ফলে ইংরেজদের সঙ্গে এই বনেদী পরিবারের মানুষদের সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠতো। বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান হলেই ইংরেজরা অবশ্যই ডাক পেতেন।

 

রামসুন্দর মিত্র চার পুত্র রেখে মারা যান। পুত্র মদনমোহনের মন ছিল না পড়াশোনায়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনি নুনের ব্যবসা শুরু করেন। প্রচুর টাকা উপার্জন করেছিলেন। পরবর্তীকালে যদিও পরিবার তাকে গ্রহণ করেন। মদনমোহনের তিন পুত্র ছিল। দ্বারিকানাথ, দীননাথ এবং অমৃতনাথ। সকলের ব্যবসায়িক বুদ্ধি যদিও সমান ছিল না, তবুও ব্যবসায় এরা সকলেই যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন।

 

কলকাতার নানা ক্ষেত্রে দান-ছত্র করার ব্যাপারে এই পরিবারের যথেষ্ট সুনাম ছিল। বিভিন্ন হাসপাতাল ও কলেজ তৈরিতে টাকা দান করেছিলেন। ১৮৬৭ সালে উড়িষ্যার মন্বন্তরের সময় ২০হাজার টাকা দিয়েছিলেন মিত্র পরিবার। ‌ তবে এই পরিবার নিজেদের যে কোনো অনুষ্ঠানে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করতেন। এই পরিবারের সদস্য নরেন্দ্রনাথ মিত্রের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে কলকাতার সমস্ত ধনী পরিবারের সদস্যরা এই নিমন্ত্রিত ছিলেন।

 

অলকেন্দ্রনাথ মিত্রের আশীর্বাদ উপলক্ষে প্রায় দেড়শটিরও বেশি রান্না করা হয়। ১১৭ টি পদ ছিল নিরামিষ তালিকায়। এই বনেদি পরিবারের যাবতীয় কাজকর্ম অন্যরকম এবং ঐতিহ্যবাহী।

 

মিত্র পরিবারের ৩৩০ বছরেরও বেশি কালীপুজো হয়ে আসছে। চোর বাগানের মিত্র বাড়ির কালী শ্যামবর্ণা, তিনি ভয়ংকরী নন ভয়হারিণী। একসময় এই কালীর নাম ছিল মিঠাই কালী। প্রায় ১৮ ফুট প্রতিমার সমান মিষ্টান্ন স্তরে স্তরে সাজিয়ে নৈবেদ্য দেওয়া হতো। পুজোর পর তা বিলি করা হত দরিদ্রদের মধ্যে। লর্ড ক্লাইভ, ওয়ার্ন হেস্টিংস এই বাড়ির কালীপূজায় এসেছিলেন। বহু উজ্জ্বল ইতিহাস নিজের ভিতর ধারণ করে আজও উত্তর কলকাতার বুকে টিকে রয়েছে চোরবাগানের মিত্র বাড়ি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...