মহাভারতে দেখা যায় ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য, কৌরব ও পান্ডবদের মধ্যে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তে মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই মহাযুদ্ধ ১৮ দিন ধরে চলেছিল। এই যুদ্ধে সহায়তার জন্য কৌরব ও পান্ডবপক্ষ উভয়েই দ্বারকাধীশ শ্রীকৃষ্ণের কাছে সহায়তার জন্য এলে শ্রীকৃষ্ণ তাদের বলেন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন যে, তিনি এই যুদ্ধে কোন পক্ষের হয়েই অস্ত্র ধারণ করবেন না। তাই একদিকে নিরস্ত্র শ্রীকৃষ্ণ অন্যদিকে তার নারায়ণী সেনা এই দুইয়ের মধ্যে থেকে তাদের একজনকে বেছে নিতে হবে। শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে অর্জুনকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ দিলে তিনি খুশিমনে শ্রীকৃষ্ণকেই বেছে নেন, কারণ অর্জুন জানতেন যে শ্রীকৃষ্ণই ভগবান নারায়ণ তাই তিনি যেদিকে থাকবেন , বিজয়ও সেদিকেই থাকবে।
অন্যদিকে দুর্যোধন খুশি মনে স্বীকার করেন নারায়ণী সেনা, কারণ তিনি মনে করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ অস্ত্র ধারণ করবেন না, তাই তিনি দুর্বল, অসহায়। কিন্তু দুর্যোধন এটা বুঝতে পারেন নি, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান। তাই তাঁর উপস্থিতিই আসলে বিজয় স্বরূপ। মূলত এই দিনই পান্ডবদের বিজয় ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল। এরপর মহাভারতের যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের সময় দেখা যায় কৌরব পক্ষে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কর্ণর মত রথী, মহারথীরা ও বিপুল সংখ্যক সৈন্য থাকার পরেও কৌরব পক্ষ ধীরে ধীরে পরাজিত হতে থাকে। মহাভারতের রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, যখন কৌরবরা পরাজিত ও পান্ডবরা বিজয়ী হলেন, তখন অশ্বত্থামা এক ভয়ঙ্কর প্রতিজ্ঞা করে বসলেন।
১৮ তম দিনের রাত্রিবেলায় উরুভঙ্গ হওয়া দুর্যোধন ও নিশ্চিহ্ন হওয়া কৌরবকুলকে দেখে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা দুর্যোধনকে রাত্রিবেলা যুদ্ধ করার জন্য অনুমতি চাইলেন। অশ্বত্থামা বললেন, রাত্রিবেলা আমি একাই যুদ্ধ করে পঞ্চপান্ডবকে নির্মূল করে দেব। সেইসময় রাতের বেলা যুদ্ধ করা নিষেধ ছিল, তবু দুর্যোধন অনুমতি দিলেন। পান্ডবদের ঘোর বিপদ বুঝে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শরণাপন্ন হলেন মহাদেবের। শ্রীকৃষ্ণের প্রার্থনায় খুশি হয়ে মহাদেব পান্ডবদের শিবির নিজে রক্ষা করবেন বলে রাজি হন আর দেবাদিদেব মহাদেব এই দায়িত্ব স্বয়ং নিজের কাঁধে নেওয়ায় শ্রীকৃষ্ণ নিশ্চিন্ত হলেন। শ্রীকৃষ্ণ তখন হস্তিনাপুরে চলে গেলেন আর পঞ্চপান্ডব তখন সরস্বতী নদীর তীরে রাত কাটাতে গেলেন, রাতে যুদ্ধ না হওয়ায় তারা নিশ্চিন্ত হলেন। রাত্রিবেলা অশ্বত্থামা পান্ডব শিবিরে এলেন। অশ্বত্থামা এসে দ্বার রক্ষক হিসেবে থাকা শিবকে বললেন, আমি ভেতরে ঢুকতে চাই। শিব দ্বার ছেড়ে দিলেন এবং তাকে একটা তলোয়ারও দিয়ে দিলেন।
অশ্বত্থামা ভিতরে গিয়ে দেখলেন সকলে নিদ্রারত। শিবিরের ভিতরে তখন দ্রৌপদীর পাঁচ ছেলে একই বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে ছিল, পঞ্চপান্ডব মনে করে অশ্বথামা শিবের দেওয়া তলোয়ার দিয়ে তাদের মাথা কেটে ফেললেন। উল্লেখ্য, দ্রোপদীর এই পঞ্চপুত্রের নাম, প্রতিবিন্ধ্য , সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানীক ও শ্রুতসেন। প্রতিবিন্ধ্য যুধিষ্ঠিরের পুত্র, সুতসোম ভীমের, শ্রুতকর্মা হল অর্জুন পুত্র আর শতানীক নকুলের ও শ্রুতসেন সহদেবের পুত্র।
পরদিন সকাল হওয়ার পর জানা গেল পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র ঘুমন্ত অবস্থায় মারা গিয়েছেন। দেবাদিদেব মহাদেব শিবির পাহারায় থাকার পরেও এমন কাজ ঘটালো অশ্বত্থামা, শোকে ও ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে গেলেন পঞ্চপাণ্ডব। পাঁচ ছেলের মৃত্যুতে তারা শিবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তারা যত অস্ত্র মারেন শিব সবকিছু আত্মসাৎ করে নেন। ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব তখন অস্ত্র ফেলে শিবের গায়ে প্রহার করতে শুরু করলেন, একমাত্র যুধিষ্ঠির শিবের গায়ে হাত তোলেন নি।
এইসময় রেগে গিয়ে মহাদেব বললেন, তোমরা কৃষ্ণ ভক্ত মানে আমারও ভক্ত। কিন্তু আজ তোমরা যে কাজ করলে তা অন্যায়। এর ফল তোমাদের ভোগ করতে হবে কলি যুগে। শিবের এই নিদারুণ অভিশাপ বাক্য শুনে পঞ্চপান্ডব ভেঙে পড়লেন এবং তারা আবার শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করলেন। শ্রীকৃষ্ণ সেখানে এলেন ও পঞ্চপান্ডবের মুখ থেকে সব শুনে মহাদেবকে স্মরণ করে বললেন, তিনি যেন পান্ডবদের উপর দয়া করেন ও তাদের যে সকল অস্ত্র তিনি গ্রহণ করেছেন তা যেন ফিরিয়ে দেন। একইসঙ্গে মহাদেব যেন পঞ্চপান্ডবকে অভিশাপ থেকেও মুক্ত করে দেন এই কথাও শ্রীকৃষ্ণ দেবাদিদেব মহাদেবকে বলেন।
দেবাদিদেব তখন বললেন, সবই তো তোমার মায়া-কৃষ্ণ। যা কিছু হয়েছে সব তোমার মায়ার প্রভাবেই হয়েছে। তবে আমার উচ্চারিত বাক্য ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না আর এই অভিশাপও বিফল হবে না। যুধিষ্ঠির কলিতে বৎসরাজের পুত্র হয়ে জন্মাবে। তার নাম হবে বলখানি। সে শিরীষপুরের রাজা হবে। ভীম আমাকে খুব কু বাক্য বলেছে, তাই সে ম্লেচ্ছ কুলে বীরণ নামে জন্মাবে। অর্জুন পরিমলের ছেলে হয়ে জন্মাবে। তার নাম হবে ব্রহ্মা নন্দ, নকুল লক্ষণ নাম নিয়ে কান্যকুজের রাজা রত্নভানুর পুত্র হয়ে জন্মাবে আর সহদেব রাজা ভীমসিংহের ছেলে দেব সিংহ নামে জন্মাবে। শ্রীকৃষ্ণ দেবাদিদেব মহাদেবের এই কথা মেনে নিলেন। পঞ্চপান্ডবও বুঝলেন এই তাদের নিয়তি। দেব অভিশাপ বিফলে যাবে না। পরবর্তীকালে দৈববাণী ফলপ্রসূ করে শাপগ্রস্থ হয়ে পঞ্চপান্ডব আবার কলিকালে জন্ম করেন।
তথ্যসূত্রঃ ভবিষ্য পুরাণ