দেবতার জন্ম: বাবা হাইকোর্টেশ্বর

আজ তিন বিচিত্র শিবের কথা বলব আপনাদের। ঠিক যেন শিবরামের দেবতার জন্ম, বা পিকে সিনেমার সেই দৃশ্য! প্রয়োজনের তাগিদে, ভয় থেকে সৃষ্টি হয় ভক্তির। জন্ম হয় ঈশ্বরের...! তার আগে বাঙালির শিব নিয়ে একটু ধারণা দিয়ে দিই বরং! নজরুল

ইসলাম তাঁর গানে বলে গিয়েছেন-

'হে শিব সুন্দর, বাঘছাল পরিহর
ধরো নটবর বেশ, পরো নীপমালা।'

বাংলার ঘরের শিবের উপস্থাপনা শুরু হয় মধ্যযুগে, মঙ্গলকাব্য ও লোকসংস্কৃতির হাত ধরে পল্লীবাংলায় মিশে গিয়েছেন শিব। লৌকিক দেবতা পাঁচু ঠাকুর, চাঁদ রায়, ধর্ম ঠাকুর, ক্ষেত্রপাল প্রমুখের মাধ্যমেই শিব হয়েছেন সকলের। কৃষকদের হাতে পড়ে তিনি চাষা হয়েছেন। জেলেদের মধ্যে হয়েছেন মাকাল ঠাকুর। বাংলায় বৌদ্ধ প্রভাবের পরে লক্ষ্মণ সেন ও তাঁর পরবর্তী আমলে উঠে এসেছেন ‘চাষা শিব’। তিনি মাটি কর্ষণ করছেন, ত্রিশূল বন্ধক রেখে লাঙ্গল কিনছেন, তারপর ফসলও বুনছেন। একেবারে ঘরোয়া সংসারী মানুষ হয়ে উঠছেন শিব।

বাংলার মঙ্গলকাব্য শিবকে আদুরে জামাই পরিচয় দিয়েছে। বলশালী চেহারা নয়, তিনি সুঠাম স্বাস্থ্যবান নন, মস্ত এক ভুঁড়ি ও গোঁফ রয়েছে তাঁর। গাত্রবর্ণ সাদা। কালীঘাটের পটচিত্রই হোক, বা যামিনী রায়ের আঁকা- সর্বত্রই শিব অনন্য। আবার কখনও সেই শিবই জমিতে চাষের কাজ করছেন। নন্দলাল বসুর ছবিতেও বিষপাত্র হাতে শিবের ছবি ফুটে উঠেছে। শিব এখানে নিতান্ত সাধারণ মানুষ সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ সবতেই বিদ্যমান। তিনি স্ত্রীকে ভয় পান। নির্ভেজাল মানুষ, যাকে নিয়ে মজাও করা যায়। আবার নিজেও মজা করেন। ঠিক যেন বাড়ির ছেলের মতোই তিনি। নানা আবদারে, আদরে আপ্যায়নে রাখা হয় তাঁকে।

ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে দেখা যায়- শিবের খিদে পেয়েছে। অন্নদা রাঁধতে বসেছেন। সেই পদের বিবরণ দিয়েছেন ভারতচন্দ্র-

'কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝাল ঝোল রসা।
কালিয়া দোলমা বাগা সেকচী সমসা।।
অন্ন মাংস সীকভাজা কাবাব করিয়া।
রান্ধিলেন মুড়া আগে মসলা পুরিয়া।।'

অর্থাৎ শিব আমিষভোজী ঝাল, ঝোল, রসা, কালিয়া, দোলমাসহ নানা পদের সমাহারে তিনি ভোজন করবেন। ঘরের লোক হলেও তাঁকে ভালমন্দ দিতেই হয়। বিজয় গুপ্তর মনসামঙ্গলে রয়েছে শিব ডাবের জল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে খাবেন বলে বায়না ধরেছেন। আবার গাঁজা খেয়ে, নেশা করে চোখ লাল করে পড়ে থাকেন শিব। আবার এই অন্নদামঙ্গলেই শিব হাজির হয়েছেন বুড়া শিব হিসেবে। রায়গুণাকর বলছেন-

"কেহ বলে ওই এল শিব বুড়া কাপ।
কেহ বলে বুড়াটি খেলাও দেখি সাপ।।
কেহ বলে জটা হৈতে বার কর জল।
কেহ বলে জ্বাল দেখি কপালে অনল।"

বুড়ো শিবকে তাঁর সাপটিকে খেলানোর জন্য বলা হচ্ছে। আবার বলা হচ্ছে, বুড়া শিব জটা থেকে জল বার করো। যা জীবনের সঙ্গে মেলানো, নিপাট ঘরোয়া ছবি। বাইরে থেকে কেউ এলে আমরা যেমন বলি এটা দেখাও, ওটা দেখাও; ঠিক তেমনটাই যেন উঠে এসেছে এখানে। শিবের কাছে আবদার করা যায়, বায়না করা যায়। শিব এখানে ঈশ্বর নন, বরং তাঁকে অন্যরূপে চিনেছে বাংলা। বাংলা তাঁকে আপন করে নিয়েছে। তাই বাংলায় শিব ঘরের লোক, সাধারণের একজন, তিনি হয়ে উঠেছেন ঘরের ছেলে।

এবার তিন শিবকে চিনে নেওয়ার পালা, বিধাননগর স্টেশন ছেড়ে এগিয়ে চলেছে শিয়ালদার দিকে। হঠাৎ কাঁকুড়গাছির কাছেই দেখতে পাওয়া যায় লাইনের ধারে ছোট্ট মন্দির, উপরে লেখা লাইনেশ্বর শিব। শিবের এমন নাম শুনলেই চমকে উঠবেন! ইনি হাল আমলের দেবতা। ট্রেন দুর্ঘটনার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই এই শিবঠাকুরের উৎপত্তি। রাস্তাঘাটে চলার পথে এরকম অনেক নতুন শিবঠাকুরের দেখা পেতেই পারেন।

তেমনই একজন হলেন বেকারেশ্বর শিব। এই বেকারেশ্বর শিবে মন্দির হুগলির হিন্দমোটরে অবস্থিত। একদা এলাকার বেকার ছেলেরা এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছে। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এখানে পুজো দিলেই মিলবে চাকরি। কেউ আর বেকার থাকবে না। আবার রয়েছেন কোচবিহারের মেখলিগঞ্জে টেনশন ঠাকুর। দেবতাকূলে সদ্য জন্ম নেওয়া এই ঠাকুর নাকি লোকেদের টেনশন লাঘব করেন। হালে তো করোনাকেও মানুষ ঠাকুর বানিয়ে ফেলেছে।

এমন এক বিচিত্র ঠাকুরের কথা বলি, তিনিও শিব বাবা হাইকোর্টেশ্বর। হাইকোর্ট চত্বরে যাঁদের নিত্য যাতায়াত রয়েছে, তাঁদের কাছে বাবা হাইকোর্টেশ্বর নামটি বহুল পরিচিত। কিরণশঙ্কর রোডে অবস্থিত এই হাইকোর্টেশ্বর মহাদেবের মন্দির। মামলা মোকদ্দমার রায় বেরনোর আগে, উকিল থেকে শুরু করে মক্কেল সব্বাই জয়ের আশায় একবার হলেও বাবা হাইকোর্টেশ্বরের থানে মাথা ঠুকে আসেন। বাদ যান না বিচারপতিরাও। কেউ কেউ তো মানসিকও করেন। আবার সেই মানসিক পূর্ণ হলে প্রণামীতে ভরিয়ে দিয়ে যান।

জনশ্রুতি রয়েছে, প্রায় একশো বছর আগে উড়িষ্যার থেকে আসা জনৈক জগদীশ চন্দ্র গিরি হাইকোর্ট অঞ্চলের একটি গাছের তলায় এই শিবলিঙ্গ খুঁজে পান। তখন থেকেই শুরু হয় হাইকোর্টেশ্বর বাবার পুজো। তবে আরও পরে ১৯৫৬ সালে মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। আজও পুজো পেয়ে আসছেন বাবা হাইকোর্টেশ্বর। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শংকরের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল হাইকোর্ট চত্বরেই। তার লেখাতেও হাইকোর্টেশ্বরের উল্লেখ রয়েছে তিনি লিখছেন- "আইনপাড়ায় একজন ‘হাইকোর্টেশ্বর’ ছিলেন, কিন্তু তাঁর দাপট তেমন নয়। তিনি বাদী-বিবাদী দু’পক্ষের কাছ থেকেই আগাম পুজো নিতে আপত্তি করতেন না।"

মন্দিরের গায়ে ফলকে হাইকোর্টেশ্বর মহাদেবের নাম বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি তিনটি ভাষাতেই লেখা আছে। হাইকোর্ট চত্বর সম্প্রীতির বার্তা দেয়, এই মন্দিরের অদূরেই রয়েছে একটি মসজিদও, সেখানে মুসলমান মক্কেল ও উকিলেরা গিয়ে থাকেন। ভক্তদের কথায় বাবা হাইকোর্টেশ্বর খুবই জাগ্রত। তাই বলি মামলা-মোকদ্দমা থেকে রেহাই পেতে হাইকোর্টেশ্বরের কাছে মাথা ঠুকুন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...