স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। নামটির সঙ্গে প্রথম পরিচিতি খুব ছোটবেলায় বাবার কাছে। গল্প বলত বাবা। এই গল্পটি আমার এবং আমার ভাইয়ের খুব প্রিয় ছিল। ট্রেনে করে একবার স্যার আশুতোষ যাচ্ছেন আলিগড়। প্রথম শ্রেণীর সুরক্ষিত ট্রেনের কামরায় তাঁর সঙ্গী ছিলেন এক মিলিটারি অফিসার। ট্রেনের সফরকালে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সেই সময় তাঁর পায়ের নাগরা জুতো জোড়া ওই সাহেব মিলিটারি জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়। কোনোভাবে আশুতোষ তা টের পেয়ে যান। তিনি সেই মুহূর্তে কিছুই বললেন না তাঁর সঙ্গীকে। পরে ওই মিলিটারি যখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, তখন তার কোটটি নিয়ে আশুতোষ ফেলে দিলেন। সাহেবের যখন ঘুম ভাঙল, তিনি তো বেজায় চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। ট্রেনে তো আর কেউ নেই। কে করবে সেই কাজ? আশুতোষ নির্বিকার। পায়ের ওপর পা তুলে নাচাতে নাচাতে তিনি বললেন, "তোমার কোট আমার জুতো খুঁজতে গেছে"। দারুন উদ্দীপিত হতাম গল্পটা শুনে। বাবা বলতও তেমনি করেই। মাঝে মাঝেই শুনতে চাইতাম এই গল্পটি। এইভাবেই 'বাংলার বাঘ' পরিচিত হন আমাদের কাছে।
এই ছিলেন স্যার আশুতোষ। নিজের জাত চেনাতেন তিনি নিজের মতন করে। পৃথিবীর কোনো মানুষকেই পাত্তা দিতেন না। তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে সরাসরি রাজনীতিতে যোগ না দিয়েও কিভাবে ব্রিটিশদের ওপর রাজত্ব করা যায়, তা শিখিয়েছিলেন আশুতোষ। সংস্কৃত পন্ডিত পরিবারে কলকাতায় জন্মগ্রহন করেছিলেন আশুতোষ ১৮৬৪ সালের ২৯শে জুন। বাবা গঙ্গাপ্রসাদ ছিলেন পেশায় ডাক্তার। পন্ডিত পরিবারের রক্ত যাঁর শরীরে রয়েছে, তিনি নিজে যে যথেষ্ট পান্ডিত্যের অধিকারী হবেন তা বলাই বাহুল্য। শোনা যায়, স্কুলে ছাত্রাবস্থাতেই আশুতোষ মিল্টনের 'প্যারাডাইস লস্ট' মুখস্ত বলতে পারতেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তাঁর সহপাঠী ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। কলেজে সহপাঠীদের চেয়ে সব বিষয়ে এগিয়ে ছিলেন তিনি। সেই সময় থেকেই তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল।
১৮৮৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এ পরীক্ষা দেন এবং 'ঈশান ও ভিজিয়ানাগ্রাম' বৃত্তি এবং 'হরিশচন্দ্র পুরস্কার' পেয়েছিলেন। সেই বছরেই তিনি 'লন্ডন সোসাইটি'র ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হন। এম এ পরীক্ষাতেও তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। পরের বছর পান 'প্রেমচাঁদ বৃত্তি' এবং পদার্থবিদ্যা নিয়ে দ্বিতীয়বার এম এ-তে উত্তীর্ণ হন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনিই প্রথম ছাত্র, যিনি দু'টি বিষয়ে এম এ পাশ করেছিলেন। মূলত পদার্থবিদ্যা এবং অঙ্কের ছাত্র হলেও তিনি ছিলেন ইতিহাস, ইংরেজি সাহিত্য ও দর্শনের গভীর অনুরাগী। ১৮৮৫ সালে তিনি আইন নিয়ে পড়াশুনো শুরু করেন এবং পরে স্বর্ণ পদক সহ বি এল ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।
১৮৮৭ সাল থেকে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বাঙালি পরীক্ষক ছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্সি কলেজে থাকাকালীন তিনি বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ লিখেছিলেন যা পরবর্তীতে ছাত্র-ছাত্রীদের যথেষ্ট কাজে আসে। মাত্র ২৫ বছর বয়সে গাণিতিক গবেষণার জগতে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পরে জিওমেট্রিক্যাল কনিক'স নামক একটি বই লেখেন শিক্ষার্থীদের জন্য। 'রয়াল এস্ট্রোলোজিক্যাল সোসাইটি অফ লন্ডন' এবং 'রয়াল সোসাইটি অফ এডিনবরা'-র ফেলো নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও 'এশিয়াটিক সোসাইটি'র সদস্য হয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ব্যাপারে তিনি ছাত্রাবস্থা থেকেই নিজের মতামত ব্যক্ত করতেন এবং তা যথাযোগ্য মর্যাদায় গৃহীত হত। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রেও তাঁর মূল্যবান মতামত গৃহীত হয়েছিল। পরে ১৮৮৮ সাল থেকে কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন। ১৮৯৪ সালে ডক্টর অফ ল উপাধি লাভ করেন। তারপর ১৯০৪ সাল থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯২০ সালে কিছুদিনের জন্য তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্বও পালন করেছিলেন। তাই বলাই যায় তিনি একাধারে ছিলেন আইনজীবী, বিচারক এবং অবশ্যই একজন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ।
পাশাপাশি তাঁর দৃঢ় ব্যক্তিত্বের জন্য তিনি পরিচিত ছিলেন 'বাংলার বাঘ' হিসেবে। ১৯০৬ সালে কলকাতার ভাইস চ্যান্সেলর হন স্যার আশুতোষ। আগে এম এ পড়ানো হত কলেজে কলেজে। বিশ্ববিদ্যালয় ছিল শুধুমাত্র এডমিনিস্ট্রেটিভ বডি। তিনি প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ পড়ানোর রীতি শুরু করলেন। পড়ানোর জন্য আহ্বান জানালেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পন্ডিতদের। তৈরী হল সিলেবাস। তবে ছাত্রদরদী আশুতোষ অধ্যাপকদের বলে দিলেন, প্রশ্নপত্র যেন অধ্যাপকদের বিদ্যে জাহির করার কাগজ না হয়। তিনি নিজে স্ক্রুটিনি করে তবেই ফাইনাল হবে প্রশ্নপত্র। অঙ্কের অধ্যাপক গৌরীশঙ্কর দে মহাশয় তৈরী করেছিলেন অঙ্কের প্রশ্নপত্র। দেখাতে নিয়ে গেলেন স্যারের বাড়ি। আশুতোষ প্রশ্নপত্র দেখে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে গৌরীবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর হাতে কি আড়াই ঘন্টা সময় হবে, গৌরীবাবু কিছু বুঝে উঠতে পারেননি। মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিলেন তা হবে। এবারে বাড়ির পরিচারককে আশুতোষ আদেশ দিলেন গৌরীবাবুকে কাগজ আর কলম এনে দিতে। সেই সময় তিনি স্নানে যাচ্ছিলেন। গৌরীবাবুকে বললেন, "আমি তাহলে স্নানে যাই গৌরীবাবু, আপনি ততক্ষণে প্রশ্নপত্রের অঙ্কগুলো কষে ফেলুন"। কি আর করা। গৌরীবাবু বসলেন অঙ্ক কষতে। ঠিক আড়াই ঘন্টা বাদে আশুতোষ এসে বললেন, "আপনার লেখা শেষ হল"? গৌরীবাবুর তখনও দু'তিনটে অঙ্ক বাকি। মুখ কাঁচুমাচু। স্যার তখন বললেন, দেখুন, "আপনারই সময় মত প্রশ্নপত্র শেষ হলনা, ছাত্ররা পারবে কি করে? বাড়ি গিয়ে ঠান্ডা মাথায় তাদের কথা ভেবে তাদের মত করে প্রশ্নপত্র তৈরী করুন"। এই ছিলেন স্যার আশুতোষ।
তিনি ছিলেন বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন বিরল ব্যক্তিত্বের মানুষ। ছিলেন নিরামিষাশী। পছন্দের খাবারের তালিকায় প্রথমেই ছিল 'সন্দেশ'। তাঁর পছন্দের তালিকায় ছিল কাঁচাগোল্লাও। কখনো কারো কাছ থেকে কিছু নেননি তিনি, তবে শোনা যায় কেউ কাঁচা গোল্লা বা সন্দেশ নিয়ে এলে ভারী খুশি হতেন। তাঁর বাড়িতে সকলের ছিল অবারিত দ্বার। প্রতিদিন সকাল থেকেই বহু মানুষ বিভিন্ন আর্জি নিয়ে তাঁর কাছে ভিড় করতেন। ছিলেন যথেষ্ট নিয়মানুবর্তী। রোজ ভোর চারটের সময় ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ নিজস্ব কাজ করার পর তিনি বেরিয়ে পড়তেন ময়দানে প্রাতর্ভ্রমনে।
১৯১১ সালে তিনি নাইট উপাধি পেয়েছিলেন। প্রাচ্যের ভাবধারার মধ্যে দিয়ে পাশ্চাত্যের শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। উদার মন নিয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন তিনি। তাই তো এমন গ্ৰহণযোগ্য হয়ে উঠেছিলেন সকলের কাছে এবং পরাধীনতার যুগেও দেশের তথা বাংলার মানুষের জন্য বিভিন্ন রকম সংস্কার সাধন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯২৪ সালের ২৫ মে পাটনায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলায়, বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থায় তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।