কালী কথা: পুণ্যক্ষেত্র পানিহাটির হলদে কালী মন্দির

পানিহাটি হল বৈষ্ণবদের পবিত্র তীর্থস্থান। স্বয়ং চৈতন্যদেবের পা পড়েছে এই শ্রীপাটে। পানিহাটি যতটা বৈষ্ণবের ততটাই শাক্তের। এখানেই রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন একাধিক কালী মন্দির। তেমনই একটি কালী মন্দির হল হলদে কালী বাড়ি। না না, দেবীর গাত্রবর্ণ হলুদ নয়। আশেপাশের অঞ্চলে কোনও বাড়িতে বিয়ে হলে পাত্র-পাত্রীর গাত্র হরিদ্রাভ করার জন্য এই মন্দির থেকে হলুদ যেত। এই মন্দির থেকে হলুদ না-গেলে গায়ে-হলুদের অনুষ্ঠান বা বিয়ে হত না। সেই থেকেই মন্দিরের নাম হয় হলুদ কালী বাড়ি। তারপর উচ্চারণ ভেদে মন্দিরের নাম হয় হলদে কালী বাড়ি। দেবীর নাম হয় হলদে কালী। মহোৎসব তলা ঘাট, বাঘব ভবন, ইস্কন মন্দির, ত্রাণনাথবাবুর কালী মন্দির আর বয়ে চলা পতিতপাবনী গঙ্গার পাশে এই কালী মন্দির অবস্থিত। পুণ্যক্ষেত্র পানিহাটির অনন্য উপাদান হলদে কালী।

 

ইতিহাস বলছে মন্দিরের বয়স ৩৩০ বছর। এলাকার তৎকালীন প্রতাপশালী ব্যক্তি ঈশান চক্রবর্তী’র জামাই কেদারনাথ মুখোপাধ্যায় ১৬৯৪ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। কেদারনাথ ছিলেন কালী ভক্ত এবং তন্ত্র সাধক। ত্রৈলোক্যনাথ ছিলেন তাঁর গুরু। তিনি বেনারসে গঙ্গার ধারে বসে তন্ত্র সাধনা করতেন।

কেদারনাথ মুখোপাধ্যায় বেনারসে তাঁর গুরুর কাছে তন্ত্র দীক্ষা নেন। মন্দিরের দেবী কালী হলেন দক্ষিণা কালী, আনন্দময়ী। মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় কাশীধাম থেকে কষ্টিপাথরের কালী বিগ্রহ নিয়ে আসা হয়েছিল। সেই মূর্তিই এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়। মাতৃমূর্তি চতুর্ভুজা।

 

মন্দিরের প্রবেশদ্বারের বাঁ দিকে রয়েছে পঞ্চমুণ্ডীর ঘর। জনশ্রুতি রয়েছে, এই ঘরেই এক হঠযোগী সিদ্ধ পুরুষ পঞ্চ মুণ্ডীর আসনে বসে তন্ত্র সাধনা করতেন। কেউ কেউ বলে ওই হঠযোগী আর কেউ নন স্বয়ং কেদারনাথ মুখোপাধ্যায়। এই মন্দিরকে ঘিরে একাধিক অলৌকিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। অনেকেই বলেন, প্রতি রাতে মন্দিরের দরজা বন্ধ করার পরও ভিতর থেকে ধূপ-ধুনোর সুগন্ধ ভেসে আসে। অনেকের দাবি, এলোকেশী মা আনন্দময়ীকে গভীর রাতে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেও নাকি দেখেছেন। এমনকী, দেবী নাকি এক অসুস্থ ভক্তের কপালে হাত রেখে তাঁর রোগ সারিয়ে দিয়েছিলেন বলেও শোনা যায়। মন্দির সংলগ্ন মাটিতে পড়ে যাওয়া বিশাল অশ্বত্থ গাছটি আপনাআপনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, আবার ভক্ত দেবীর কাছে প্রার্থনা করে পরিবারের নিখোঁজ সদস্যের সন্ধান পেয়েছেন বলেও শোনা যায়। মন্দিরের চুরি যাওয়া গয়নাও উদ্ধার হয়, হৃদরোগীর হৃদরোগ সেরে যায়, ভক্তদের কাছে মাছ খাওয়ার আবদারও করেন। ভক্তদের বিশ্বাস, পানিহাটির হলদে কালী লীলাময়ী।একদা মন্দিরে বলিদান হত। কিন্তু মায়ের স্বপ্নাদেশে এখন বলিদান বন্ধ।

 

বাংলার ১১০১ সনে ঈশান চক্রবর্তীর কন্যা ও জামাতা দুজনে মিলেই কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। চক্রবর্তী পরিবারের বংশধরেরাই আজও মন্দিরের দেখভাল করছেন। মন্দিরে নিত্যপুজো হয়। সন্ধ্যায় আরতি হয়। দুপুরে ভোগে দেওয়া হয় চিড়ে, বাতাসা আর সন্ধ্যায় সন্দেশ। এককালে দুপুরে অন্নভোগ দেওয়া হত। মহা ধুমধাম করে কার্তিক অমাবস্যায় শ্যামা পুজো আয়োজিত হয় এখানে। দীপান্বিতা তিথিতে আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। বিশেষ পদ মাছের মাথা ও চিংড়ি মাছ দিয়ে বানানো চচ্চড়ি নিবেদন করা হয়। থাকে খিচুড়ি, কাতলা মাছের কালিয়া, চাটনি, পায়েস। এছাড়াও প্রতি অমবস্যায় বিশেষ পুজো হয়। দেবী এখানে অভয়দায়িনী হিসাবেই পূজিতা হন।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...