চিরদিনের "গুপী গাইন"

মনে করুন আজ থেকে বছর পঞ্চাশ আগের কথা। সেই সময় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হলে গিয়ে সিনেমা দেখা বারণ। যারা সিনেমা দ্যাখে, সিনেমার আর্টিস্টদের নিয়ে কথা বলে - তারা সব বাজের দলে। তাদের সঙ্গে বেশি মিশলে মা বকেন। কখনো কষিয়ে দু চার ঘা। তো এরকম একটা যুগেও দেখা গেল যে বাড়ির ছোটদের নিয়ে তাদের মা বাবা কাকা পিসি দাদু ঠাম্মা মানে পরিবারের সবাই মিলে একটা সিনেমা দেখতে চলেছে। সিনেমার নাম "গুপী গাইন বাঘা বাইন"...ছবির পরিচালক সত্যজিৎ রায়। আর এই সিনেমায় গুপির ভূমিকায় অভিনয় করে অমর হয়ে গেলেন যে অভিনেতা--তার নাম তপেন চট্টোপাধ্যায়। তপেন চট্টোপাধ্যায় আর গুপী এমন সমার্থক শব্দ হয়ে গেলো যে গুপী চরিত্রে পরবর্তী সময়ে কোনো চিত্র পরিচালক আর কাউকে ভাবতেই পারলেন না–বলা ভালো ভাবার সাহসই পেলেন না। সেইজন্য "হীরক রাজার দেশে" এবং "গুপী বাঘা ফিরে এলো"র পরে আর ঐ দুই কালজয়ী চরিত্র নিয়ে ছবিও তৈরি হলো না।

নলিনী রঞ্জন চট্টোপাধ্যায় এবং শোভনা চট্টোপাধ্যায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান তপেন ১৯৩৭ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর কোলকাতায় জন্মগ্ৰহণ করেছিলেন। ছোট থেকেই অভিনয়ের প্রতি টান। সেটা আবার পিতা নলিনী রঞ্জনের একটুও পছন্দ নয়। কিন্তু ভবিষ্যতে যিনি কালজয়ী চরিত্রে অভিনয় করবেন তার পক্ষে অভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ এড়ানো কিছুতেই সম্ভব ছিলো না। ক্লাস এইটে পড়তেই তিনি নাটকে অভিনয় করেছেন। নাটকের নাম অচলায়তন। ছোট চরিত্র... কিন্তু তাঁর অভিনয় দর্শকদের মনে দাগ কেটে গেছিলো। অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে খুব কম বয়সেই চাকরি পেয়ে চলে যান রাজস্থানে। কিন্তু নিপাট বাঙালি তপেনের রাজস্থানের জল বাতাস সহ্য হয় নি। ফিরে এলেন কোলকাতায়। কাকা ছিলেন ‌বিখ্যাত কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন কাকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী গীতা চট্টোপাধ্যায়ের নাটকের গ্ৰুপে যোগ দিলেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তপেন চট্টোপাধ্যায়ের পরিবারের অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রেই তপেন বাবু সন্দেশ পত্রিকায় কাজ শুরু করলেন। পাশাপাশি সিনেমায় টুকটাক অভিনয়। সত্যজিৎ রায়ের 'মহানগর' ছবিতে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এরপর আসে সত্যজিৎ রায়ের সেই যুগান্তকারী ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ.. জীবনের মোড় ঘুরে গেলো তপেন চট্টোপাধ্যায়ের।

সত্যজিৎ পত্নী বিজয়া রায় লিখছেন...

"বাঘার চরিত্রে রবিকে নেওয়া প্রথম থেকেই ঠিক ছিল, কিন্তু গুপীর চরিত্রে কাকে নেবেন, মানিক ভেবে কিছুতেই ঠিক করতে পারছিলেন না। অনেক দেখানো হল, এমনকী একজনের স্ক্রিন টেস্ট নেওয়া হয়েছিল রবির সঙ্গে, যিনি এক ডেলি পেপারের সম্পাদক ছিলেন। কোনও ফল হয়নি।

চঞ্চলবাবুর (চঞ্চল চট্টোপাধ্যায়) ভাইয়ের ছেলে তপেন আমাদের বাড়িতে মাঝেসাঝে আসত। ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে প্রথম দিকে ছিল। মানিক তাঁর অভ্যাস মতো গুপীর চরিত্রে যে-ধরনের মুখ ওঁর চাই, সেটা এঁকে রেখেছিলেন। চেহারার মধ্যে একটা গ্রাম্য ভাব থাকবে, বেশি চালাক চটপটে নয়।

ভাগ্যক্রমে একদিন তপেন আমাদের বাড়িতে এসেছিল। মানিকের ঘরে ঢুকতেই মানিক ওর দিকে ফিরে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ‘এই তো পেয়ে গেছি’ গোছের ভাব। তপেন এর আগে ‘মহানগর’ ছবিতে একটা ছোট্ট ভূমিকায় নেমেছিল।

তপেন আমাকে পরে বলেছিল, মানিক যখন ওকে জানালেন, ‘গুপী’-র চরিত্রর জন্য ওকে ভাবা হচ্ছে, তখন তপেন এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে, বিশ্বাস করতে পারছিল না। যখন জানতে পারল যে, ওর মুখের সঙ্গে গুপীর মুখ প্রায় মিলে গেছে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে ফিরতে পারেনি। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে চোখের জল চেপে রাখতে চেষ্টা করেছিল। প্রথমবারের পক্ষে তপেন সত্যি অসাধারণ অভিনয় করেছিল এবং বি.এফ.জে.এ - তে সর্বশ্রেষ্ঠ নতুন অভিনেতার জন্য পুরস্কৃতও হয়েছিল।".....
......আমাদের কথা, বিজয়া রায়

গুপী গাইন বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশে, গুগাবাবা ফিরে এল এই তিনটি ছবিতেই গুপীর ভূমিকায় তপেন চট্টোপাধ্যায়। দেশে বিদেশে বহু সম্মান লাভ করেছিলেন এই চরিত্রে অভিনয়ের সুবাদে। গুপীর লিপে অনুপ ঘোষালের গানগুলি!!"দ্যাখো রে নয়ন মেলে জগতের বাহার" অথবা "আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে".... এতোদিন ধরে শুনেও বাঙালির কাছে এতটুকুও পুরনো হয় নি।

তপেন চট্টোপাধ্যায় আরো বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন যেমন ধন্যি মেয়ে, সাধু যুধিষ্ঠিরের করচা, সঙ্গিনী, গণদেবতা, ননীগোপালের বিয়ে...। কিন্তু মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে 'গুপী গাইন' হিসেবেই।

প্রসঙ্গত, গুপী গাইন চরিত্রে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন স্বয়ং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সত্যজিৎ রায় তাঁর মতো সুদর্শন অভিনেতাকে না নিয়ে সরল সাধাসিধে চেহারার তপেন চট্টোপাধ্যায়কে বেছে নিয়েছিলেন। বাকিটা ইতিহাস। একটা বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করে মানুষের মনে বসবাসের "চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত" করে নিলেন গুপী গাইন ওরফে তপেন চট্টোপাধ্যায়।

কৃতজ্ঞতা: বিজয়া রায় (আমাদের কথা)

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...