স্বামী বিবেকানন্দ কি কেবলই একজন সন্ন্যাসী?

রবি ঠাকুর, সুভাষচন্দ্র, যদুনাথ সরকারেরা যথাক্রমে বলেছিলেন, বিবেকানন্দ ভারতের ঘনিভূত অবস্থা, ভারতবর্ষকে চিনতে হলে বিবেকানন্দকে পড়তে হবে, তিনিই প্রেরণার জীবন্ত ফোয়ারা। স্বামী বিবেকানন্দ কি কেবলই একজন সন্ন্যাসী? নিছক ইষ্ট নাম জপ করা এক সাধু হিসাবে তাঁকে ব্যাখ্যা করা যায় না। পূর্বপুরুষ দুর্গাচরণ, তাঁকে কতটা অনুপ্রাণিত করেছিলেন বা আদৌ করেছিলেন কি-না জানা যায় না। হয়তো ঈশ্বরের স্বরূপ অনুসন্ধানের বাসনা নরেনকে বিবেকানন্দ হওয়ার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল।

 

ঠাকুর পরমহংসদেব রোগ শয্যায় বিবেকানন্দের থেকে কথা আদায় করে নিয়েছিলেন, নরেন যেন দুর্গম পাহাড়ে বা গহীন জঙ্গলে সাধনা করে জীবন না কাটিয়ে দেন। লোক শিক্ষাই নরেন্দ্রের জীবনের উদ্দেশ। তাই তো ঠাকুর বলতেন, নরেন শিক্ষে দেবে। মন্ত্র দিয়ে গিয়েছিলেন লোকসেবার। জীব জ্ঞানে শিব সেবা। আধ্যাত্মিকতা আর মানব সেবার মিশলে যদি এই উপমহাদেশে কেউ ঘটিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর নাম বিবেকানন্দ। বিদ্বেষ, বিভাজন, মেরুকরণের উর্ধ্বে উঠে তিনি সেবার ধর্মের প্রচার করে গিয়েছেন। বলেছেন শূদ্র জাগরণের কথা। যার মধ্যে নিহিত ছিল শোষিতের হাতে ক্ষমতা, অর্থাৎ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। এও তো স্বাধীনতার স্বপ্ন।

 

ছেলেবেলা থেকে নরেনের মধ্যে ছিল নৃপতি হওয়ার যাবতীয় গুণ। পাড়ার দস্যি ছেলেদের জুটিয়ে দুরন্তপনা হোক বা পেটুকদের নিয়ে গ্রিডি ক্লাব তৈরি, মুগুর ভাজা, কুস্তি সবতেই প্রথম সারিতে তিনি। নেতৃত্ব তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ তৈরির সময়তেও এই নেতৃত্বের গুণ সোনা ফলিয়েছিল। 

 

কৈশোর থেকে তরুণ বয়সে প্রবেশের সময়, ঈশ্বরের স্বরূপ খোঁজার যজ্ঞ শুরু করেন নরেন। ব্রাহ্ম সমাজ তাঁর কৌতূহল নিঃসরণ করতে পারেনি। নরেন গিয়ে পড়েন দক্ষিণেশ্বরের কালীঘরের পাগলা ঠাকুরের কাছে। ধীরে ধীরে বিশ্বাস জন্মায় কালীর প্রতি। কিন্তু গ্রাস করতে পারেনি পৌত্তলিকতা। বাবা চলে গিয়েছে, আয় উপার্জন নেই, অভাব, অনাহার, আত্মীয়দের মামলা মোকদ্দমার প্যাঁচ; কিছুই টলাতে পারেনি নরেনকে। অবিচল থেকে গিয়েছেন তিনি। পরমহংসের মৃত্যুর পর, তাঁর ভক্তিবাদকে আন্দোলনের রূপ দেন। সেখানেও অগ্রাধিকার পেয়েছে সেবা, শিক্ষা এবং লোকশিক্ষা। গোটা ভারত ঘুরে তিনি চিনেছিলেন দেশের আত্মরূপ। দেশবাসীর যন্ত্রণা দেখেছেন। সেই প্রেক্ষিত বিচার করে নির্ধারণ করেছেন নিজের পথ, সঙ্ঘের কার্য কৌশল। বিপদে অনড় দাঁড়িয়েছেন।

 

নিবেদিতা, সারা বুল, ওলে বুলদের ডেকে এনেছেন ভারত গড়ার কাজে। রাখাল মহারাজকে দিয়েছেন সঙ্ঘ চালানোর দায়িত্ব, শরদ মহারাজকে দিয়ে প্রচার করিয়েছেন গুরুর কথা। প্লেগ পীড়িত কলকাতাকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তরুণদের বলেছেন বেদান্ত পাঠ করতে। বিশ্বের দরবারে গিয়ে প্রমাণ করে এসেছে নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব। হিন্দু ধর্মের গ্রহণযোগ্যতার বাণী বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। হিন্দুধর্ম মানে ব্রত, উপোস আর সংস্কারের নামে চাপানো কুসংস্কার নয়! বেদে নিহীত বাস্তবতা, শাস্ত্রের আদত ব্যাখ্যা প্রচার করেছেন। সঙ্ঘজননীকে দেখেছেন পুত্রের মতো।

 

বিবেকানন্দ এমন মানুষ, যাঁকে নিজের রথ নিজেকেই টানতে হয়েছে। নিজেই নিজের সারথী, নিজেই নিজের চালিকাশক্তি আবার খোদ তিনিই সওয়ারি। শিকাগো থেকে ফেরার পর গোটা কলকাতা তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। আবার তাঁকেই শুনতে হয়েছে তিনি কায়েতের ছেলে কীসের সম্বর্ধনা? আদপে মুকুট তো ছিল তাঁর, কিন্তু সেই মুকুট ছিল কাঁটায় জর্জরিত। কাঁটার মুকুটই ছিল তাঁর শিরোস্ত্রাণ। তা পরতে দ্বিধা করেননি ভুগবেনশ্বরীর বিলে। তাই তো শেষটায় তাঁর মুখে থেকেই বেরিয়েছিল, আর একটা বিবেকানন্দ থাকলে বুঝত এই বিবেকানন্দ কী করে গেল! সর্ব অর্থেই তিনি বীর সন্ন্যাসী।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...