ইতিহাসের পাতায় বিস্মৃত এই লেখিকা হয়ে উঠতে পারেন বহু ব্রাত্য মানুষের অনুপ্রেরণার কারণ

জেলে বন্দী এক নারী। শুধু বই পড়েন। পড়াশোনার প্রতি তাঁর অধ্যাবসায় অবাক করেছিল জেলে বন্দি বাকিদের। সেই নারী আসলে রাজনৈতিক বন্দী ছিলেন। বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গ্রেফতার বরণ করেছিলেন দৃঢ়চেতা এই নারী। পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও যথাসময়ে বি.এ পরীক্ষা দিতে পারেননি জেলে থাকার কারণে। জেলে বসেই তিনি আবেদন জানান পরীক্ষা দেওয়ার। কড়া ভাষায় লেখা আবেদন পত্রকে অস্বীকার করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। জেল থেকে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি পান এই নারী। তিনি সুলেখা সান্যাল।

সুলেখা সান্যাল লেখিকা , কবি, কথাসাহিত্যিক। তবে সর্বোপরি তিনি এক লড়াকু মহিলা। তিনি লড়াই করেছেন লিউকেমিয়ার সঙ্গে। তিনি লড়াই করেছেন নিজের অন্তরাত্মার সঙ্গে। কখনও আপনজনদের দেওয়া ব্যথায় তিনি ব্যথিত হয়েছেন। কিন্তু জীবনের প্রতি আশ্চর্য ভালোবাসা ছিল তাঁর। তাই কখনও জীবন থেকে মুখ ফেরান নি। ইতিহাসের পাতায় ব্রাত্য এই কথাসাহিত্যিকের জীবন অনুপ্রেরণার কারণ হতে পারে অনেকের।

১৯২৮ সালের ১৫ জুন সুলেখা সান্যাল-এর জন্ম। চট্টগ্রামে মাসির বাড়িতে কেটেছিল তাঁর শৈশব। সাত বছর বয়সে প্রথম বইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। পড়াশোনা আর অক্ষর চর্চা তাঁকে জীবনের যে কোনো আঘাতে ছায়ার মতো করে আগলে রেখেছিল। ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম বোমা বিস্ফোরণের পর নিজের গ্রামে ফিরে আসেন এবং ১৯৪৪ সালে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।

১৯৪৬ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আইএ পাস করে কলকাতায় গিয়ে ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছিলেন বি.এ পড়ার জন্য। ১৯৪৮ সালে এক রাজনৈতিক সহকর্মীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন।

বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গ্রেফতার বরণ করতে হয়েছিল তাঁকে। যথাসময়ে বি.এ পরীক্ষা দিয়ে উঠতে পারেননি। তবে গ্রেফতার হওয়ার পরেও পড়াশোনার প্রতি নেশা ছাড়তে পারেননি। জেলে বসে বি.এ পরীক্ষা দেন এবং পাস করেন।

সুলেখা সান্যালের জীবনের মোড় বদল হয় এখানে। শরীরে ধরা পড়ে মারণ রোগের জীবাণু। লিউকেমিয়া ধরা পড়েছিল তাঁর। ১৯৫৭ সালে তিনি মস্কো গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। এখানে আবার বদল আসে তাঁর জীবনে। আঘাত পেয়েছিলেন ভালবাসার মানুষের কাছ থেকে। হতাশ হয়ে ফিরে এসেছিলেন মস্কো থেকে। শরীরে ক্যান্সার, মনে ক্ষত। আঘাতে আঘাতে তিনি তখন জর্জরিত। অন্তরাত্মা ক্ষতবিক্ষত। এই সময় দরকার ছিল ছায়ার। এই ছায়া তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন। সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে নিজের ভেতরের যন্ত্রণার উপশম ঘটিয়েছিলেন।

খুব সামান্য সাহিত্যজীবন ছিল তাঁর। ১৯৬২ সালের ৪ ডিসেম্বর মারা যান তিনি। দুটি উপন্যাস এবং বেশ কিছু ছোট গল্প রচনা করেছিলেন। বেশিরভাগ গল্পের মূল উপজীব্য ছিল দেশভাগ। ১৩৬৩ বঙ্গাব্দে তাঁর একমাত্র ছোটগল্প সংকলন সিঁদুরে মেঘ প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর আরও ২৩ টি গল্পের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। সেই সব গল্পগুলি একত্রে মোট ১৮ টি গল্পের একটি সংকলন সুলেখা সান্যাল-এর গল্প সংগ্রহ নামে প্রকাশ করেছিলেন তার ছোট বোন সুজাতা সান্যাল।

ছাব্বিশ বছর বয়সে লেখা তার উপন্যাস নবাঙ্কুর। পরবর্তীকালে এই উপন্যাসের দুটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। নবাঙ্কুর আসলে একজন নারীর হয়ে ওঠার কথা বলে। একজন নারীর কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠার কাহিনী শোনায় এই উপন্যাস।

স্বল্প সাহিত্য জীবনে মাত্র দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন অকাল প্রয়াত এই লেখিকা। নিজের ব্যক্তি জীবনকে উপন্যাসের প্লট হিসেবে রচনা করতে তিনি সংকোচ বোধ করেননি।তাঁর লেখায় বাস্তব ঘনিষ্ঠতা অন্যতম উল্লেখ্য বিষয়।

তাঁর লেখা ছোটগল্পগুলোকে তিনটি ধারায় ভাগ করা যেতে পারে। একদম প্রথম দিকে রচিত তাঁর ছোট গল্প, পরবর্তীকালে রচিত গল্পগুলোয় মূলত দাঙ্গা এবং দেশভাগজনিত যন্ত্রণা প্রকাশ পেয়েছে, একেবারে শেষে তাঁর ব্যক্তি জীবনের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মনের প্রভাব পড়েছে গল্পে। ছোট্ট জীবনে সুলেখা সান্যাল অনেক কষ্ট পেয়েছেন, ব্যথাকে সঙ্গী করে তিনি নিজেকে গড়ে-পিঠে নিয়েছেন। তাঁর বোনের কথায় তিনি জীবন থেকে পাওয়া তিক্ততা , বিশ্বাসহীনতা, নিঃসঙ্গতায় যে শূন্যতাবোধের মধ্যে দিয়ে গেছেন সে সময়েই তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনাগুলি রচিত হয়েছে। তাঁর জীবনযন্ত্রণাই তাঁকে বিদগ্ধ সাহিত্যিক হিসেবে উপস্থাপিত করেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...