দেবীভাগবতে আছে, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এরা প্রত্যেকেই দেবী মহামায়া শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে পেরে দেবীর নানা প্রকারের স্তব স্তোত্র করা শুরু করেন। ব্রহ্মা-বিষ্ণু মহেশ্বরকৃত সেই স্তবে তাঁরা কী বলেছিলেন জানেন?
ভগবান বিষ্ণুর স্তব
ভগবান বিষ্ণু বলেছিলেন, যিনি সমগ্র সৃষ্টির আদি, যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূল শক্তি, অসীম এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যাঁর রচনা, সেই পরমা প্রকৃতি জ্যোতির্ময়ীকল্যাণী দেবীকে আমি বারংবার প্রণাম জানাই। তিনি সকল ভক্তদের মুক্তির পথ দেখান আবার ভক্তদের সকল মনস্কামনা পূর্ণ করেন। সত্ত্ব, রজ ও তম- এই তিন গুণের উর্ধ্বে তিনি অবস্থান করেন আবার এই তিন গুণকে তিনি নিজেই নিয়ন্ত্রণ করেন। এই ব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু হয় সৃষ্টি, পালন, প্রলয় সবের মূল আধার তিনি। যাঁর ইচ্ছেতে ধ্বংসের পর নতুন সৃষ্টি হয় আর যিনি নতুন করে সৃজন করেন, করুণার আধার যিনি সেই পরম মাতৃময়ী শক্তিকে আমি বারবার নত মস্তকে প্রণাম জানাই।
ভগবান বিষ্ণু বলেন, এই সমগ্র বিশ্ব আসলে মায়াময়। এই মায়া দেবীর খেলা। দেবী স্বয়ং প্রত্যেকটা মুহূর্তে এই মায়া রচনা করেন অথচ তিনি এই মায়ার অধীন নন। তিনি মায়ার বাইরে থাকেন এবং সর্বত্র চৈতন্য রূপে প্রকাশিত হন। সৃষ্টির সময় তিনি ষোড়শ বিকার ও সপ্ত প্রকৃতির রূপ ধারণ করে আকাশ , বায়ু, অগ্নি, মাটি ও জল অর্থাৎ পঞ্চভূতের দ্বারা এই মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেকটা মুহূর্তে তিনি তার লীলার দ্বারা অসংখ্য জীবকে মায়ায় আচ্ছন্ন করছেন ও মায়া থেকে উদ্ধার করেন। সেই লীলাময়ীকে আমার প্রণাম।
ভগবান নারায়ণ আরও বলেছেন যে, হে দেবী আপনি সূর্যকে আলো দেন বলেই জগৎ আলোকিত হয় আপনি আমাদের ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা,বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে শক্তি দেন তাই আপনার শক্তিতে আমরা শক্তিমান। আপনি থাকলে জগৎ থাকবে আর আপনি না থাকলে জগৎ প্রকাশিত হতে পারবে না। কল্পের শুরুতে আপনি জগত সৃষ্টি করেছিলেন আবার প্রলয়ের সময় আপনি নিজের শক্তিতে জগৎ লীন করে দিয়েছেন। আপনার শক্তির প্রকৃত পরিমাপ আমরা করতে অক্ষম। মধু, কৈটভ দানবের হাত থেকে রক্ষা করে আপনি আমাদের রক্ষা করেন, আপনি আমাদের অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ডের ছায়া দেখিয়েছেন যার দ্বারা আমরা উপলব্ধি করেছি যে একটি মাত্র জগৎ নয়, অসংখ্য জগৎ আপনার মধ্যে সমাহিত। প্রতিটি ভুবনেই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর আলাদা আলাদা রূপে বিরাজমান। তাই আমরা আপনার শক্তির আভাস মাত্র, কিন্তু আপনার শক্তিকে বোঝা আমাদের সাধ্যাতীত।
এরপর ভগবান নারায়ণ প্রার্থনা করে বলেন, মা, আমাকে আশীর্বাদ করুন, আমি যেন চিরকাল আপনার দাস রূপে থাকতে পারি। আপনার রূপ যেন সবসময় আমার হৃদয়ে প্রকাশিত হয়, আমার জিহ্বা যেন সর্বদাই আপনার নাম উচ্চারণ করে আর আমার চোখ যেন সর্বদাই আপনার চরণপদ্ম দর্শন করে এবং আমাদের সম্পর্ক যেন মা ও ছেলের মত দৃঢ় হয় আপনি বেদের জননী, আপনি গায়ত্রী মাতা, আপনি স্বাহা-স্বধা, আপনি লক্ষীর কান্তি, কীর্তি ও সন্তোষ। মানুষের জগতে বৈরাগ্য - জ্ঞান - মুক্তির শক্তিও আপনি।
ভগবান সবশেষে বলেন, এই জগৎ নিরন্তর নাটকের মত চলছে, আপনার শক্তিতেই আমরা সবাই অভিনয় করে চলেছি প্রতিনিয়ত। কিন্তু যখন কেউ আপনাকে চিনতে পারে তখন সে বোঝে আপনি সমস্ত কিছুর মূলে আর সবাই আপনার দ্বারা পরিচালিত। দেবী আমার আপনার কাছে করজোড়ে অনুরোধ, আমি আপনাকে আশ্রয় করছি, জন্ম মৃত্যুর চক্র , দুঃখ দুর্দশা , মোহময় সাগর থেকে আপনি আমাকে উদ্ধার করুন।
মহাদেব কৃত দেবীর স্তব
ভগবান নারায়ণের পর দেবাদিদেব মহাদেব দেবীর উদ্দেশ্যে স্তব করেন। তিনি বলেন, হে দেবী সৃষ্টি পালন সংহার সবের মূলে তুমি। দেবাদিদেব মহাদেব তাই বলেছেন, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মতো আমার উৎপত্তি ও যে আপনার থেকেই তাতে আর আশ্চর্য কী? দেবাদিদেব মহাদেব বলেন যে পঞ্চ ভূত থেকে শুরু করে জ্ঞানেন্দ্রিয় (অর্থাৎ কান , চোখ, নাক, জিহা ও ত্বক) কর্মেন্দ্রিয় (অর্থাৎ হাত, পা এবং বাক) সবই দেবীর রূপের প্রকাশ। বুদ্ধি, অহংকার, মন - এসবই দেবীর রূপ। আপনাকে সম্যক রূপে কেই বা জানতে পেরেছে
আমাদের শরীরের ভেতর ও বাইরের সবকিছুই তো আপনার থেকেই উদ্ভূত। যখন আমরা ত্রিদেব(ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর) আসল তত্ত্ব ভুলে যায়, তখন আমরা ভ্রমে পড়ি এবং মনে করি আমরাই স্রষ্টা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আপনি চেতন শক্তিরূপে আমাদের মধ্যে রয়েছেন। আপনার লীলাতেই নিরন্তর সৃষ্টি ও ধ্বংস প্রক্রিয়া চলছে, আপনি কখনো আমাদের শক্তি দেন আবার কখনো নিজেই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর রূপ ধারণ করে লীলা করেন আবার আপনার ইচ্ছাতেই প্রলয় হয়। ব্রহ্মা যখন সৃষ্টি করেন , বিষ্ণু যখন পালন করেন, আবার আমি যখন সংহার করি তখন তা আসলে আপনারই শক্তি। রজ গুণ থেকে সৃষ্ট ব্রহ্মা, সত্ত্ব গুণ থেকে সৃষ্ট বিষ্ণু আর তমোগুণ থেকে সৃষ্টি আমি আর আমাদের তিন কাজের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে দেবীর তিনগুণ প্রকাশিত হয়।
মহাদেব আরও বলেন যে আমি আপনার পাদপদ্ম ছাড়া আর কিছুই চাই না। কারণ আমি জানি আপনার আশ্রয় ছাড়া কোথাও সুখ নেই, শান্তি নেই, সত্যিকারের আনন্দ নেই। আপনিই এই ত্রিভুবনে সর্বশ্রেষ্ঠ।
ব্রহ্মা কৃত দেবীর স্তব
ভগবান নারায়ণ এবং দেবাদিদেব মহাদেবের মুখ থেকে দেবীর প্রতি এই স্তব বাক্য শুনে ব্রহ্মার অহংকার ভেঙে যায়। এর আগে পর্যন্ত ব্রহ্মা ভাবতেন তিনি এই জগতকে সৃষ্টি করেন কিন্তু যখন পূর্ববর্তী দুই দেব দেবীর আরাধনা করলেন এবং জানালেন তারা পর্যন্ত দেবীর শক্তির একটি অংশ মাত্র তখন ব্রহ্মা বুঝতে পারলেন তিনি কিছুই নন তিনি নিমিত্ত। তখন তিনি দেবীর স্তব ও প্রার্থনা করতে শুরু করলেন।
ব্রহ্মা তখন বলেন, দেবী মহামায়া, আপনি সকল সৃষ্টির স্থিতি এবং সংহারের মূল। একাধিক শাস্ত্রে আপনার কথা প্রকৃতভাবে উল্লেখ না থাকলেও সেই শাস্ত্রে বর্ণিত সকল দেবতা ইন্দ্রাদি প্রমুখ আপনারই সৃষ্টি। সকল শক্তির উৎসরূপ আপনি, যজ্ঞ -হোমে উচ্চারিত দেবী স্বাহাও আপনার অংশভূত। তাই সমস্ত যজ্ঞ প্রবর্তকও আপনি। আমি একসময় অহং বশত নিজেকে সর্বজ্ঞানী ভেবে ছিলাম ও অহংকারের কারণে আমি দুঃখ ও মোহের সাগরে পতিত হয়েছি। তবে এখন আমি বুঝতে পারছি সবই শক্তির খেলা। তাই দেবীর কাছে আমি ক্ষমা চাইছি।
ব্রহ্মা দেবীর কাছে প্রার্থনা করেন, দেবী যেন কৃপাপূর্বক তাকে নিজের মোহজাল থেকে মুক্ত করে ভক্তি দান করেন। এরপর ব্রহ্মা দেবীকে অদ্বিতীয়া বলেন। সবশেষে ব্রহ্মা বলেন, দেবী আপনি পুরুষ না স্ত্রী তা আমাকে সত্য ভাবে বলুন। আপনাকে যথার্থভাবে জানতে পারলেই আমি আমার কর্ম সঠিকভাবে করতে পারব ও মুক্তি লাভ করব। হে সর্বকার্যের কারণ,সকল যোগীর আশ্রয় আপনি কৃপা পূর্বক আপনার যথার্থ রূপ আমাকে দর্শন করান, আমি সকল আমিত্ব ত্যাগ করে আপনার চরণে আত্মসমর্পণ করলাম।