জন্মের সময় কেন বৃন্দাবনবাসী কেন ভেবেছিল শ্রীমতি রাধা অন্ধ!

রাধা নামের সুরে বাজে কৃষ্ণের মোহন বাঁশি। পূর্বরাগ থেকে বিরহে। বিরহ যত বাড়ে, অদর্শনের ব্যথা যত বাড়ে, তত গভীর হয় বাঁশির সুর। রাধা ছাড়া অসম্পূর্ণ কৃষ্ণ। রাধাকে ভগবান কৃষ্ণের ‘আধ্যাত্মিক শক্তি’ হিসাবে মনে করা হয়।

রাধা লক্ষ্মীর অবতার। জন্মাষ্টমীর ১৫ দিন পর রাধা অষ্টমী পালন করা হয়। কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী থেকে রাধা জন্মাষ্টমী মাঝের ১৫ দিন সময় রাধাকে একটি পদ্মপাতায় বিশ্রাম নেন। প্রবাদ বলে কৃষ্ণ তার না আসা পর্যন্ত রাধা চোখ খোলেন না। সেই কারণেই বেদ ও পুরাণ প্রভৃতিতে তাঁকে ‘কৃষ্ণবল্লভা’, ‘কৃষ্ণাত্মা’ কৃষ্ণপ্রিয়া ‘বলে অভিহিত করা হয়।

IMG-20230922-WA0013

রাজা শ্রীবৃষভানু এবং তাঁর স্ত্রী শ্রীকীর্তি রাধাকে নিজের মেয়ে হিসাবে বড় করেছিলেন। এবং তিনটি কল্পতে রাধা ও কৃষ্ণের শক্তি বর্ণিত রয়েছে।কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি হিসেবে শ্রীমতি রাধারানীর প্রকাশ হয়। শ্রীমতি রাধিকাই হচ্ছে আদি শক্তি। তপ্তসোনার মতো গায়ের রং তাঁর। রত্ন অলংকারে বিভূষিতা।

শ্রীকৃষ্ণের আনন্দ বিধানের জন্য তিনি নিজের অঙ্গ থেকে অসংখ্য গোপিকাদের প্রকাশ করেন। এই সমস্ত ব্রজাঙ্গনারা রূপে-গুণে সর্বোত্তমা ছিলেন। শ্রীমতি রাধারাণী ও তাঁর কায়ব্যুহ গোপিকাদের মায়াবদ্ধ জীবদের মতো জন্মগ্রহণ করতে হয়নি।

তাঁরা সকলেই শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তির প্রকাশ। তাঁরা গোলোকে শাশ্বতকাল ধরে অবস্থান করছেন এবং শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে লীলা বিলাস করে কৃষ্ণপ্রেম আস্বাদন করছেন।

পদ্ম পুরাণের উত্তর খণ্ডে শিব-পার্বতী সংবাদে ভৌম বৃন্দাবনে শ্রীমতী রাধারাণীর জন্ম সম্পর্কে একটি কাহিনি পাওয়া যায়।

সেই কাহিনি অনুযায়ী, বৃন্দাবনে বৃষভানু রাজা নামে এক পরম ভক্ত বাস করতেন। তাঁর কীর্তিদা সুন্দরী নামে এক পতিপ্রাণা স্ত্রী ছিল। তাঁরই গর্ভে ভাদ্রমাসে শুক্লাষ্টমী তিথিতে মধ্যাহ্নে শুভক্ষণে শ্রীমতী রাধারাণী জন্মগ্রহণ করেন।

বৃষভানুর কন্যারত্ন দর্শনে সমগ্র বৃন্দাবন দিব্যানন্দে মগ্ন হল। কন্যার রূপে সকলে মুগ্ধ হলেও তাঁর চোখ কোনভাবেই উন্মেলিত না হওয়ায় সকলে ভেবেছিল এই কন্যা সুন্দরী হলেও অন্ধ।

এমন ঘটনার নেপথ্যেও আছে এক উপকাহিনি। সেই কাহিনি এরকম-

একদিন গোলোকে কৃষ্ণ রাধারাণীকে জ্ঞাপন করলেন যে, তিনি অতি শীঘ্রই পৃথিবীতে অবতরণ করবেন। সুতরাং রাধারাণী যেন সেখানে অবতরণ করেন। মর্ত্য জন্মে উভয়ের মধ্যে বিচিত্র মাধুর্য লীলা বিলাস হবে।

কৃষ্ণের কথা শুনে রাধারানী বললেন যে, যদি তাঁকে পৃথিবীতে অবতরণ করতে হয়, তা হলে পর পুরুষের মুখ দর্শন করতে হবে। কিন্তু রাধারানী শ্রীকৃষ্ণের রূপমাধুরী ছাড়া অন্য কিছুই দর্শন করেন না। তাই তাঁর পক্ষে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করা কি করে সম্ভব?

রাধারাণীর যুক্তিসংগত কথা শুনে কৃষ্ণ বললেন যে, সেই জন্য তাঁর চিন্তার কোন ও কারন নেই। রাধারানী সব সময় কৃষ্ণকেই দেখতে পাবেন। তবেই হরিপ্রিয়া রাধারানী মর্ত্যলোকে অবতীর্ণ হতে রাজি হয়েছিলেন।

এদিকে রাধিকার শুভ জন্ম-মহোৎসব উপলক্ষ্যে আমন্ত্রিত হয়ে স্ত্রী ও পুত্রসহ নন্দ মহারাজ বৃষভানু রাজার রাজপুরীতে এসে উপস্থিত হন। তাঁরা পরস্পরে আনন্দে কোলাকুলি করছিলেন,তখন এক ফাঁকে কৃষ্ণ অন্তঃপুরে রাধার পালঙ্কের কাছে এসে দাঁড়ালেন। তখন শ্রীরাধা তাঁর চোখ খুলে কৃষ্ণের দিকে তাকালেন। এভাবেই উভয়ে উভয়কে দর্শন করে দিব্য আনন্দে নিমগ্ন হন।

বৃষভানু রাজা অন্তঃপুরে প্রবেশ করে দেখলেন, রাধিকা চোখ উন্মীলিত করে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে আছে, তখন তিনি আনন্দের আতিশয্যে উভয়কে কোলে তুলে নিলেন এবং বুঝতে পারলেন যে, কৃষ্ণই রাধাকে চক্ষুদান করেছেন। রাধার চক্ষু উন্মীলনের খবর পাওয়া মাত্রই সমগ্র ব্রজবাসীরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়েছিলেন।

আরও একটি কাহিনি মেলে রাধা জন্ম প্রসঙ্গে। সেই কাহিনি অনুসার,    

কথিত আছে, একসময় সূর্যদেব পৃথিবী ভ্রমণ করতে আসেন। সেই সময় পৃথিবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তিনি মন্দর পর্বতের গুহায় গভীর তপস্যায় মগ্ন হন। সূর্যদেব দিনের পর দিন তপস্যায় রত থাকায় পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। স্বর্গের দেবতারা তখন সৃষ্টি রক্ষার জন্য শ্রীহরির স্মরণাপন্ন হন। ভগবান বিষ্ণু সূর্যের সামনে এসে তাঁর ধ্যান ভঙ্গ করেন ও তাঁকে বর দিতে চান।

সূর্যদেব তাঁকে বলেন, 'আমাকে এমন একটি গুণবতী কন্যা দিন যার কাছে আপনি চিরকাল বশীভূত থাকবেন।' শ্রীহরি তাঁকে তথাস্তু বলে সেই বর প্রদান করেন। শ্রীহরি সূর্যকে বলেন যে পৃথিবীর ভার লাগবের জন্য তিনি দেবকী ও বসুদেবের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করবেন এবং বৃন্দাবনে নন্দালয়ে পালিত হবেন। সূর্যদেব সেখানে বৃষভানু রাজা হিসেবে জন্ম নেবেন।

এই বৃষভানুর মেয়ে হিসেবেই জন্ম হয় শ্রীরাধিকার। এই ত্রিলোকে শ্রীহরি একমাত্র রাধারই বশীভূত। শ্রীকৃষ্ণ সবাইকে আকর্ষণ করেন, কিন্তু রাধাই একমাত্র শ্রীকৃষ্ণকে আকর্ষণ করতে পারেন। বৃন্দাবনের বর্ষাণা এলাকার রাভেলে এই দিনেই জন্ম হয়েছিল শ্রীরাধিকার।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...