বাঙালির স্বর্ণ যুগের দলিল লেক মার্কেটের ‘রাধুবাবু’

তিরিশের দশক। স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউয়ে উথালপাতাল গোটা দেশ। ইংরেজদের অত্যাচারের পারদ যত বাড়ছে তত উত্তপ্ত হচ্ছে চারপাশের পরিস্থিতি। পুড়ছে বাংলা। ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে বিদ্রোহের আগুন।

বাঁকুড়ার সোনামুখীর এক যুবক রাধাকিশোর দত্ত জড়িয়ে গিয়েছিলেন সেই আন্দোলনে। একেবারে সরাসরি। শেষ পর্যন্ত একদিন পুলিশের হানায় ঘরছাড়া হতে হল। নিজের ভূমি ছেড়ে পাড়ি দিলেন ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুরে। বাঁকুড়া ফেরার পথ প্রায় বন্ধ। কিন্তু কত দিন আর এভাবে লুকিয়েচুরিয়ে বাংলা ছাড়া হয়ে বাঁচা যায়! চলে এলেন কলকাতায়।

অনিশ্চিত জীবন আঁকড়েই শুরু করলেন এই শহরে থিতু হওয়ার ভাবনা। পেট চালাতে গেলে কিছু একটা করা চাই। মহানগরে কালীঘাটের প্রান্তে শুরু হল জীবনের এই নয়াপর্ব।

দক্ষিণ কলকাতার কালী ঘাট আর রাসবিহারীর ঠিক মাঝখানে জনক রোডে রাস্তার ধারে শুরু করলেন এক চিলতে চায়ের দোকান। ঠিকানা ৮এ, জনক রোড, কলকাতা- ৭০০০২৯, লেক মার্কেট অঞ্চল। লেক মলের ঠিক পাশের গলি। বড় রাস্তা থেকে কয়েক পা হাঁটলেই সামনে ‘Radhu Babu's Tea Shop’ ডাক নামে ‘রাধু বাবু’।

এক দশক পর সেই দোকান আর শুধুমাত্র 'চায়ের দোকান' থাকল না। 'রাধুবাবুর চায়ের দোকান' হয়ে উঠল জনক রোডের প্রাণ কেন্দ্র।

দু’বেলা খোলে দোকানের দরজা। সকালে দোকান খোলা হয় ৬টা থেকে বেলা ১০টা। বিকেলে ৩:৩০ থেকে রাত সাড়ে ৮টা।

ভোরবেলা শুরু হয় ব্যস্ততা। প্রথমে প্রাতঃভ্রমণকারীদের ভিড়। তারপর রোদ যত বাড়ে, তত বাড়ে  আড্ডাবাজদের আনাগোনা। সকালের মেনুতে থাকে চা, কফি, অমলেট, পোচ, টোস্টের মতো ব্রেকফাস্ট আইটেম।

বিকেলে ‘রাধুবাবু’ আরও রঙ্গিন। মেনুর বৈচিত্র্যও নজরকাড়া। তবে লাইমলাইটের কেন্দ্রবিন্দু মাটন স্ট্যু আর চিকেন স্ট্যু। এছাড়াও আছে চিকেন কাটলেট, ফিশ ফ্রাই, কবিরাজি, চিকেন রোস্ট, মাটন চপ আরও কত কী!    

রাজনীতি থেকে গান, খেলা, ফুটবল, সিনেমা সব মিলিয়ে জমজমাট আড্ডা। পথ চলতি হঠাৎ দেখলে মনে হবে রাস্তার দু ধারে মিনি পার্লামেন্ট বসেছে। দিনের আড্ডা একরকম। কিন্তু সূর্য ডুবলে আরও ঘন হয়ে ওঠে আড্ডা। স্বর্ণযুগের গানের সুর ভেসে বেড়ায় বাতাসে। এমন মজলিশ কলকাতায় আর কোনও অঞ্চলে দেখা যায় না বোধহয়!  

আড্ডার টানে কে না এসেছেন এই দোকানে! ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সুধীরলাল চক্রবর্তী, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র- নাম বলে শেষ করা যাবে না। দক্ষিণের এই আড্ডার টান এড়ানো বড় কঠিন। মিসেস সেন মানে, সুচিত্রা সেনও আসতেন। তবে গাড়ি থেকে নামার রিস্ক নেননি কোনওদিন! সেই অতীত আজও মুখে মুখে ফেরে। এই ছোট্ট চায়ের দোকান বহু কালজয়ী গানের জন্মভূমি।

এখন অবশ্য মুখ বদলেছে। কিন্তু তা বলে তারকা মুখ কিছু কম দেখা যায় না। সেলিব্রিটি দুনিয়ার অনেকেই এখানকার প্রতিদিনের চেনা মুখ।

রাধুবাবুর চায়ের দোকান এক জীবন্ত ইতিহাস। বাঙালির স্বর্ণ যুগের দলিল। সাদা সিরামিকের কাপ-প্লেটে চা পরিবেশন এই দোকানের ‘সিগনেচার’। মাঝে করোনার উৎপাতে সাদা কাপ বদলে গিয়েছিল পেপার কাপে, কিন্তু অতিমারী পেরিয়ে ফের ফিরে এসেছে স্ব-স্থানে। বদলায়নি চায়ের স্বাদ আর আড্ডা! আজও চলছে সেই ট্র্যাডিশন...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...