'নিমতনামা’ বহমান সভ্যতার স্বাদের ইতিহাস

বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি। টগবগে তেলে ফুটতে থাকা সিঙ্গাড়া। লস্যি হোক বা বিরিয়ানি। নবাবী হেঁশেলের রান্নার গল্প সবসময়ই সুস্বাদু। নবাব-বাদশাদের অন্দরমহলের অভিজাত এলাহী খানা পরিক্রমা মিথ হয়ে আছে ইতিহাস। ভোজন শুধু মাত্র ‘ভোজন’-এ সীমাবদ্ধ থাকেনি, বহু সময় হয়ে উঠে রাজনীতি চর্চার মাধ্যম। তবে স্বাদের বিলাসে সব সময়ই যে রাজনৈতিক জটিলতা এসেছে তা নয়, অনেক সময়ই নিত্য নতুন পরখের শখ বা নিছক খাদ্যপ্রেম মুখ্য হয়ে উঠেছে। এদেশের খাদ্য সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে সেভাবেই। এভাবেই আসে ঘিয়াথ শাহের নাম।

মালওয়া সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন ঘিয়াথ শাহ। রাজধানী মান্ডু। দিলদরিয়া স্বভাবের শাসক ছিলেন তিনি। শিল্প, সাহিত্য সব কিছুর সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে চলত রাজ্য শাসন।

কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে তিনি ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছেন তাঁর খাদ্যপ্রীতির জন্য। খাদ্যপ্রেম থেকেই তিনি এক ঐতিহাসিক কাজ করে ছিলেন। পনেরো শতকের প্রথম রান্নার বই লিখেছিলেন।  নাম ‘নিমতনামা’।  

খাদ্যরসিক বলতে যা বোঝায় প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন তাই। তবে শুধুমাত্র খাবারের স্বাদ গ্রহণের মধ্যেই নিজেকে যে সীমাবদ্ধ রাখতেন তা নয়, রান্না তাঁর কাছে শিল্পের মত ছিল। রান্নার পদ্ধতিকে তিনি সেই চোখেই দেখতেন।

মিলো ক্লিভ ল্যান্ডের মতো ঐতিহাসিকদের মতে নিমতনামার সঙ্গে পঞ্চদশ শতকেই লেখা খাবার নামার অসম্ভব মিল পাওয়া যায়।

উর্দু আর পারসি ভাষার মিশ্রণে লেখা হয়েছিল এই বই। রাজমহল এবং প্রচলিত খাদ্যের সংকলন। তাঁর সভার চিত্রশিল্পীদের তিনি অলংকরণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।  আরবি অক্ষরের ক্যালিগ্রাফির প্রয়োগ করা হয়েছিল। ৫০ টি মিনিয়েচার চিত্রতে সেজে উঠেছিল বই। প্রতিটি মিনিয়েচারের কেন্দ্রে ঘিয়াথ নিজে। কোন রান্না কীভাবে করতে হয় রান্নাঘরপ্রেমীদের তিনি নিজেই বোঝাচ্ছেন এই দৃশ্যই উঠে এসেছে মিনিয়েচারে।

৫০০ বছর ধরে এতটুকু ম্লান হয়নি ‘নিমতনামা’র জনপ্রিয়তা। ঘিয়াথ শাহের শুরু করা কাজ শেষ করেছিলেন তাঁর পুত্র  আবদুল-মুজাফর-নাসির শাহ।

সিঙ্গাড়া, বড়া, ডাল, কড়ি, রায়তা, লস্যির মতো সাধারণের পছন্দের খাবারের পাকপ্রণালীও পাওয়া যায় এই বইতে। বিশেষ করে ‘লস্যি’কে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কারণ মান্ডুর লস্যি এক সময়ে উত্তর-ভারতে বিখ্যাত ছিল। এইসময়ে জনপ্রিয় কাবাব, সুরুয়া মানে স্যুপ, বিরিয়ানির নাম পাওয়া গেছে। প্রতিটি পর্বের শেষে পান্ডুলিপির এক কোণে থাকত ঘিয়াথ শাহর নিজস্ব মন্তব্য থাকত।         

উপমহাদেশের খাদ্যইতিহাস, তার বদলে যাওয়ার ধারা বুঝতে মালওয়াোধিপতির লেখা ‘রেসিপিবুক’ অন্যতম মাধ্যম। এই বই শুধুমাত্র খাদ্য সংকলন হয়ে থাকেনি, ইতিহাসবিদদের কাছে হয়ে উঠেছে সমাজ দর্পন।

নিমতনামায় কিন্তু পরোটা নিয়ে বিশেষ কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে খিচুড়ি, পোলাও সমেত নানা ধরনের ভাতের বিবরণ পাওয়া গিয়েছে।

‘নিমতনামা’র পান্ডুলিপি লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে বর্তমানে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...