রামকৃষ্ণদেবের কথায় কবিরাজি ছেড়ে আদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অন্নদা ঠাকুর

কালীক্ষেত্র দক্ষিণেশ্বরের সন্নিকটেই অবস্থিত দেবী আদ্যার পীঠস্থান আদ্যাপীঠ। দেবী কালিকাই আদ্যাশক্তি মহামায়া রূপে পূজিতা হন আদ্যাপীঠ মন্দিরে। এই মন্দিরে ওঙ্কারের মধ্যে রয়েছে দেবী আদ্যার মূর্তি। তাঁর পদতলে শ্রীরামকৃষ্ণের ধ্যানরত মূর্তি। আর, দেবী আদ্যার শীর্ষে রাধাকৃষ্ণ মূর্তি।

আদ্যাপীঠ মন্দিরের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা অন্নদাঠাকুর। তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম অবশ্য অন্নদাচরণ ভট্টাচার্য। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের চট্টগ্রামের বাসিন্দা। বাবা অভয়চরণ ভট্টাচার্য। মা তিলোত্তমা দেবী। তিন সন্তানের মধ্যে মধ্যম ছিলেন অন্নদাচরণ।

১৩২১ সাল নাগাদ চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় কবিরাজি পড়তে এসেছিলেন অন্নদাচরণ। ভেবেছিলেন আয়ুর্বেদ চিকিৎসক হবেন। থাকতেন কলকাতার আর্মহাস্ট স্ট্রিটে এক বন্ধুর বাড়িতে। সেখান থেকেই বৃত্তি নিয়ে পাশ করেছিলেন কবিরাজি। বন্ধুর বাবার সাহায্যে কবিরাজির ডিসপেনসারির জন্য দোকানও ভাড়া নিয়েছিলেন। এই সময় রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাঁর। তিনি অন্নদা ভট্টাচার্যকে বলেছিলেন কবিরাজি ব্যবসা তোমার হবে না। শোনা যায়, ঠাকুর অন্নদাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ইডেন গার্ডেন্সের ঝিলে আদ্যা মা পড়ে আছেন। ওখান থেকে মাকে নিয়ে এসো। 

এই ঘটনা নিয়ে একাধিক কাহিনি শোনা যায়। সেই কাহিনি অনুসারে জানা যায়, অন্নদা ঠাকুর ঝিলে খোঁজাখুঁজি বিস্তর খোঁজাখুঁজি করার পর সত্যি সত্যিই ১৮ ইঞ্চি আদ্যা মায়ের কষ্টিপাথরের মূর্তি পান।

সেদিন ছিল রামনবমী তিথি। রাতে আদ্যা মা তাঁকে দেখা দিয়ে বলেন,  ‘অন্নদা কাল দশমী। তুমি আমায় গঙ্গায় বিসর্জন দিও’।

এই কথা শুনে অন্নদা বলেন, ‘ মা আমি কি পুজোপাঠ করিনি বলে তুমি রাগ করে চলে যাচ্ছ’?  তখন দেবী বলেন, তিনি শুধুমাত্র ধরাবাঁধা শাস্ত্র মতে পুজো পেতে চান না। ভক্তের আন্তরিকতাই তাঁর আসল পুজো। আদ্যাস্তোত্র পাঠের কথা তিনি বলেন। আদ্যা মায়ের মুখ নিঃসৃত আদ্যাস্তোস্ত্র অন্নদা ঠাকুর লিখে যান। সেই স্ত্রোত্রই আজও  আদ্যাপীঠে পাঠ হয়।

দেবী আদ্যার স্বপ্নাদেশে বিজয়া দশমীতে মূর্তিটি বিসর্জন দেন সেই মূর্তিটির মতোই তৈরি হয়েছে বর্তমান আদ্যামূর্তি। বাংলার ১৩২৫ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ অন্নদা ঠাকুরকে স্বপ্নে সন্ন্যাস দীক্ষাও দেন। ১৯১৫ সালে তিনি মন্দির স্থাপন করেন। এই ঘটনার চার বছর পর ১৯১৮ সালে ঝুলন পূর্ণিমার রাতে রামকৃষ্ণদেব অন্নদা ঠাকুরকে হৃষিকেশ যেতে বলেন। সেখানে মন্দির তৈরির আদেশ দেন তিনি।

১৯৬৭ সালে গড়ে ওঠে আজকের আদ্যাপীঠ। কালিকাস্থল হলেও এটি শক্তিপীঠ নয়। দেবীর নিত্য পুজো হয় এখানে। ভোগ প্রসাদ পান ভক্তরা। আর দুর্গাপুজো-কালী পুজোয় হয় বিশেষ অর্চনা।কালীপুজোর দিন মহাপুজোর আয়োজন হয় আদ্যা মন্দিরে।  

আদ্যাপীঠের ভোগেও রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য। রাধাকৃষ্ণের জন্য সাড়ে বত্রিশ সের চালে রান্না হয়। দেবী আদ্যার জন্য সাড়ে বাইশ সের চাল বরাদ্দ। রামকৃষ্ণ পরহংসদেবের ভোগ রান্না হয় সাড়ে বারো সের চালে। সেই ভোগ পঞ্চব্যঞ্জনে নিবেদন করা হয়। পরমান্ন ভোগও থাকে।

অন্নদা ঠাকুরের নির্দেশ ছিল, বৃহৎ ভোগ মন্দিরে যাবে না। মন্দিরের পাশে ভোগালয়ে তা সাজিয়ে দেওয়া হবে। সেখানেই নিবেদন করা হবে ভোগ। কেবল পরমান্ন ভোগ যাবে দেবীর কাছে। আজও সেই নিয়ম মানা হয় আদ্যাপীঠে। রাতে হয় ঘি এবং উৎকৃষ্ট চাল দিয়ে তৈরি অমৃতভোগ।

মন্দিরের ওয়েবাসাইট তথ্য অনুযায়ী ভোর সাড়ে ৪টে থেকে ৫টা, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সন্ধে সাড়ে ৬টা থেকে ৭টা মন্দিরের সময়। কুপন ভোগ পাওয়া যায়। তারও সময় নির্দিষ্ট।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...