আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক সমাজের মানুষের পরিবর্তন হলেও একটি বিষয় নিয়ে রহস্যের কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয় নি। এমনকি সমাজের সর্বস্তরের ছোট থেকে বড়ো সবার কাছেই এই বিষয়টা কিন্তু আজও সমান আকর্ষণীয়। আর সেটি হলো - ভূত। তাদের অস্তিত্ব আদৌ আছে কি না, সেই নিয়ে বিতর্ক অনেক পুরোনো। তবে একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে ভূতের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরকালীন। আর তাকে আরো আকর্ষণীয় করতে সাহিত্যিক সমাজের অবদান নিছক কম নয় - কারণ শীতকালে (তার উপর যদি লোডশেডিং হয়, সেই হ্যারিকেন বা মোমবাতির আলো জ্বালিয়ে) গা ছমছমে ভূতের গল্প উপভোগ করেন না বা ছায়া দেখে ভয় পায় নি এমন মানুষ কিন্তু বিরল। শুধুমাত্র সাহিত্যে নয়, মানুষ ভূতের গল্প খুঁজে বেড়ায় পোড়ো বাড়িতে, নির্জন রাস্তায় আরও নানান জায়গায়। আমাদের কলকাতাতেই আছে বেশ কিছু ভুতুড়ে স্থান যেমন রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন, হেস্টিংস হাউস, আকাশবাণী ভবন, সাউথ পার্ক গোরস্থান, ন্যাশানাল লাইব্রেরি, যারা ভূত নিয়ে চর্চা করেন তারা জানেন।
আজ তেমনি এক ভুতুড়ে বাড়ির কথা বলবো। ভূত সন্ধানীদের মতে এই শহরের সবথেকে ভূতুড়ে জায়গাদের মধ্যে অন্যতম হল উত্তর কলকাতার আহিরিটোলায় হরচন্দ্র মল্লিক লেনের ‘পুতুল বাড়ি'। রোমান শৈলীর এই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল সম্ভবত ১৮ শতকের শেষে কিংবা ১৯ শতকের শুরুতে। সেটা বাবু সংস্কৃতির যুগ। পুরোনো কলকাতায় পণ্য আসত নদীপথে, সেগুলো জমা থাকত ঘাটের আশেপাশে গুদামে। আহিরিটোলা ঘাটের কাছে এই বাড়িটাকে গুদামঘর হিসেবে ব্যবহার করা হত।
জনশ্রুতি আছে, যে বাবুরা এখানে মানুষকে অত্যাচার করে মেরেও ফেলতেন। তাদের আর্তচিৎকার ধ্বনিত হত বাড়ির কোণে-কোণে। এই বাড়ির মালিক জোর করে দাসীদের শ্লীলতাহানি করতেন। কয়েকজন দাসী এর প্রতিবাদ করায় তাঁদেরকে খুন করে পুঁতে ফেলা হয় বাড়ির পিছনে। সেই অতৃপ্ত আত্মা নাকি ঘুরে বেড়ায় আজও। কথিত আছে মধ্যরাতে এই বাড়ি থেকে শোনা যায় কান্নার শব্দ। বাড়িতে ছায়ামূর্তির উপস্থিতিও প্রত্যক্ষ করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু বর্তমানে বাড়ির একাংশ ভাড়াটেদের দখলে এবং তারা গোটা ব্যাপারটি গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। আর যদি থেকেও থাকে তাহলে ভূতের সাথে দীর্ঘদিনের সহবাস তাদের, হার্মলেস এই ভূতেরা নেহাৎই পড়শী নয়, তেনারা তাদের সিকিউরিটিও বটে। এই নিশ্চিন্ত সিকিউরিটি এই বাজারে তারা পাবেন কোথায়! এমনকি পাড়ার লোকের কাছেও বিষয়টি আশ্চর্যের। কারণ বাড়িটি বহুদিনের কিন্তু এহেন উৎপাত এর আগে ঘটেনি। পুরোনো ইট বের করা স্যাঁতস্যাঁতে বাড়ি, দিনের বেলাতেও আলো আঁধারির খেলা চলে। সম্প্রতি ভূত দেখার অতি আগ্রহে কিছু মানুষ প্রায় সারাক্ষণই ভিড় জমাচ্ছেন এখানে। কেউবা ভূতের সাথে সেলফি তোলার আশায়, তার এক ঝলক দর্শনপ্রাথী হতে ঘাঁটি গেড়েছেন কাছাকাছির কোনো জায়গায়। বাড়ির এখনকার বাসিন্দারাও ভূতের প্রতি অযথা কৌতূহলকে প্রশ্রয় দিতে তেমন আগ্রহী নন। তাই বাড়ির গেটে “কঠোরভাবে প্রবেশ নিষেধ” এর নোটিস দেওয়া। আর সেখানে আরো সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে, এই বাড়ি নিয়ে প্রচলিত ভূত সংক্রান্ত তথ্যগুলি সম্পূর্ণ মিথ্যে। ভগ্নপ্রায় দশা নিয়ে সেই বাড়ি এখনও পুরোনো কলকাতার স্মৃতিকে বহন করে চলেছে। কিন্তু আজকের ইন্টারনেটের যুগে ভূত বাবাজিরা বড়ই বিব্রত হচ্ছে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা| তাই বলাই যায়, তারা হয়ত নতুন কোনো বাসা খুঁঁজছে, যেখানে তাদের কেউ বিরক্ত করবেনা| আশা করব, তারা নতুন বাড়ি খুঁজে পাবে এবং নতুন বাড়িতে সেই ভূত সমাজ ভালো থাকবে| পাশাপশি এভাবেই এগিয়ে চলবে ভূত সমাজ এবং কলকাতার ভুতেদের ঐতিহ্য়|