দশমীতে মাছ দেখিয়ে রওনা করানো হয় উমাকে

বিজয়া দশমী, পৌরাণিক ইতিহাস বলে তিথিটির তাৎপর্য অপরিসীম। বাংলার বিজয়া দশমীর লোকাচারের সঙ্গে মিশে গিয়েছে ইলিশ বিদায় ও যাত্রা মঙ্গল। পুজো চালাকালীন বহু বনেদি বাড়িতেই মাছ ঢোকে না। দেবীর বিসর্জনের পুজো হাওয়ার পর মাছ খান বাড়ির সদস্যরা। কেউ কেউ শেষ দিনে দেবীকে ভোগেও মাছ নিবেদন করেন। তবে দশমীর দিন পূর্ববঙ্গের মানুষরা বাড়িতে ইলিশ আনেন। জোড়া ইলিশ আনার নিয়ম রয়েছে বহু পরিবারে। আদপে দশমীর দিন ইলিশ খাওয়ার পর আর ইলিশ খাওয়া হয় না। ফের ইলিশ গ্রহণ শুরু হয় শ্রীপঞ্চমী থেকে। মাঝের চার-সাড়ে চার মাস ইলিশ ধরাও হয় না। খাওয়াও হয় না।

এককালে ইলিশের বিয়ে খুবই জনপ্রিয় ছিল। জোড়া ইলিশ বাজার থেকে আনার পর কুলোয় রেখে ইলিশের মুখে একটু গঙ্গাজল দেওয়া হয়। মেয়ে ইলিশের কপালে সিঁদুরের টিপ দিয়ে নাকে পরানো হত নোলক। ছেলে ইলিশের মুখে এক খিলি পান দেওয়া হত। তারপর আইবুড়ো মেয়ের মাথায় ইলিশের কুলো তুলে দিয়ে, লাল চেলি দিয়ে কুলো ঢাকা দেওয়া হত। কলাগাছকে মাঝে রেখে সাতবার প্রদক্ষিণ করা হত। সঙ্গে গাওয়া হত ইলিশের বিয়ের গান,

"আমি ইলশা নিয়ে বিয়ে করিতে গিয়াছিলাম ও বিনোদী

ভরা নদী আমায় দেখে কদম ফুলের মালা দিল ও ননদী

 ভরা নদীর কূলে গো

 টায়রা পরা গলায় গো ও ননদী।"

বিয়ের পর ইলিশ মাছ কুলদেবীকে ভোগ দেওয়া হত। কুলপুরোহিতের বাড়িতেও তা ভোগ হিসেবে পাঠানো হত। পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যেও তা বিলিয়ে দেওয়া হত। যেমনটা বলির মাংসের ক্ষেত্রে করা হয় আরকি! পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার পটচিত্র শিল্পীরা, পটচিত্রে মাছের বিয়ের দৃশ্য আঁকেন। সেখানে মাছের বিয়ে নিয়ে গানও প্রচলিত রয়েছে।

“দাঁড়িয়া মাছের বিয়ে করাতে চলো গো রঙিলা

পাবদা, ভেটকি বলছে দেখো,

তোমার হাতের চুড়ি হবো গো রঙিলা।”

যাদের ইলিশ আনার সামর্থ নেই, তারা নিদেন পক্ষে জোড়া পুঁটি আনেন। বিজয়ার দিন শাস্ত্রমতে গৃহস্থবাড়িতে দেবীকে বিদায় জানিয়ে যাত্রা করাতে হয়। এই আচারে পুঁটিমাছ খুবই শুভ। পুঁটিমাছের গায়ে সিঁদুর দিয়ে যাত্রা করানো হয়। বাড়িতে অন্যান্য মাছ রা‌ন্না করলেও, অল্প হলেও পুঁটি মাছ রান্না করা হয়।

অনেক বাড়িতেই উমাকে বিদায় দেওয়া হয় মাছ খাইয়ে। রাঢ় বাংলায় বিভিন্ন এলাকায় দশমীর সকাল থেকেই মাছ ধরতে দেখা যায়। এই রীতিটি মাছ যাত্রা নামে পরিচিত। সনাতন ধর্মে মাছ অত্যন্ত শুভ। মাছ দেখে বা খেয়ে যাত্রা করাকে শুভ বলেই ধরা হয়। অন্যদিকে দেবী দুর্গাকে বাড়ির মেয়ে বলে মনে করেন অনেকেই। ফলে যেদিন মেয়ে বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে যায় সেদিন যাতে তাঁর যাত্রা শুভ হয় তার জন্য অনেক বাড়িতেই সেদিন মাছ খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এমনকী, বিভিন্ন বাড়িতে প্রতিমা বিসর্জন করা হয় মাছ খাওয়ানোর পর। উমারর যাত্রা শুভ করার জন্য অনেক বাড়িতেই মাছ এনে তার গায়ে সিঁদুর লাগিয়ে দরজায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। মনে করা হয় দেবী এই মাছ দেখে যাত্রা শুরু করলে তাঁর যাত্রা শুভ হবে।

দশমীর দিন যাত্রা ঘট পাতা হয়। সেকালের রাজারা শরৎকালে নবরাত্রির পর বিজয়া দশমীতে যুদ্ধ যাত্রা করতেন। কৌটিল্যর ‘অর্থশাস্ত্র’-এ এই সময়কেই যুদ্ধ যাত্রার শ্রেষ্ঠ সময় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পণ্ডিত রঘুনন্দন তাঁর ‘তিথিতত্ব’ গ্রন্থে একই কথা বলেছেন। সেই থেকেই যাত্রা ঘটের প্রচলন। বলা হয় এই দিন যাত্রা ঘট দেখে যাত্রা করলে কোনও বিপদ-আপদ স্পর্শ করতে পারবে না। কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে যাত্রামঙ্গল অনুষ্ঠান হয়। রাজ পরিবারের সদস্যদের বিশেষ কিছু জিনিস দর্শন করতে হয়। আজকাল প্রতীকী দর্শনের মাধ্যমে রীতি বজায় রাখা হচ্ছে। সবৎস্য ধেনু, বৃষ, গজ, ঘোড়া, নৃপ, গণিকা, জ্বলন্ত বহ্নি, পতাকা, কাটা মাংস ইত্যাদি (প্রতীকী) কলাপাতার ওপর রাখা হয়, রাজপরিবারের সদস্যরা তাই-ই দেখেন। বলা হয় এগুলো দেখলে বছর শুভ হবে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...