বঙ্গভূমির শক্তিপীঠ: সতীপীঠ ভ্রামরী

সতীর ৫১ পীঠের মধ্যে অন্যতম হল সতীপীঠ ভ্রামরী। জলপাইগুড়ির তিস্তা নদীর তীরে শালবাড়ি গ্রামে অবস্থিত এই সতীপীঠ।

দেবী সতী আদ্যাশক্তি স্বরূপিনী ও সদা আনন্দময়ী। তাঁর কৃপালাভের আশায় যুগ যুগ ধরে ধার্মিক হিন্দু পুণ্যার্থী ভক্তজন দেবীর আরাধনা করে আসছেন। বিভিন্ন শক্তিপীঠে দেবী ভিন্ন ভিন্ন নামে পূজিতা হন। আমাদের রাজ্যে সতীপীঠের সংখ্যা ১৩(মতান্তরে ১৪)।

শক্তিপীঠ সিরিজের এবারের পর্বে আছেন দেবী ভ্রামরী। দেবী ভ্রামরীর মন্দিরটি অথবা দেবীপীঠটি উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত। পীঠনির্ণয় তন্ত্র অনুযায়ী এটি ষোড়শ সতীপীঠ।

"ত্রিস্রোতায়াং বাম পাদো ভ্রামরী ভৈরবেশ্বর"

পীঠনির্ণয়তন্ত্র মতে, ত্রিস্রোতায় দেবী সতীর বাম চরণ পড়েছিল।

জলপাইগুড়ি জেলার ধুপগুড়ি ব্লকের তিস্তা নদীর তীরে শালবাড়ি গ্রামে অবস্থিত এই সতীপীঠ। এই মন্দিরটিকে কিছুটা সাপের মত পেঁচিয়ে তিস্তা নদী তিনটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছে তাই এই স্থানটিকে ত্রিস্রোতা বলা হয়। এখানে দেবীর ভৈরবের নাম ঈশ্বর। 

পুরাণের কাহিনী অনুযায়ী অরুণাসুর নামে এক ভয়ঙ্কর অত্যাচারী অসুর ছিল। তার আক্রমণে ত্রিলোক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। অরুণাসুরের বোন বজ্রজ্বালার বাসনা হয়েছিল যে সে চন্দ্রদেবকে বিবাহ করে তাঁর রাণী হয়ে থাকবে। কিন্তু চন্দ্রদেব তার বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে বোনের অপমানের শোধ নিতে অরুণাসুর ব্রহ্মার তপস্যা শুরু করে। তপস্যায় তুষ্ট ব্রহ্মা উপস্থিত হয়ে অরুনাসুরকে বর প্রার্থনা করতে বলেন। অসুর অমরত্ব প্রার্থনা করলে ব্রহ্মা রাজী হন না। তখন সে বর চায় যে কোনও দ্বিপদী বা চতুষ্পদী প্রাণী তাকে হত্যা করতে পারবে না। এরপর ভয়াবহ শক্তিশালী হয়ে অরুণাসুর কৈলাস আক্রমণ করলে শিবও তাকে পরাভূত করতে পারেননি। সে দেবতাদের পর্যন্ত বন্দী করল। শেষ পর্যন্ত শিবের ডাকে দেবী মহামায়া ভ্রামরী রূপে আবির্ভূত হয়ে বিশাল আকার ধারণ করেন। স্থির হয় ছয় পদ বিশিষ্ট ভ্রমরেরা তাঁর সৈন্য হিসাবে যাবে। দেবীর মহিমায় শত সহস্র ভ্রমর এবং অন্যান্য পতঙ্গ-আক্রমণে এবং দেবীর প্রহারে অসুর নিহত হয়। তারা অরুণাসুরকে দংশন করে ও তাকে সম্পূর্ণ ভক্ষণ করে। এরপর দেবতারা পুনরায় স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করেন। সেই ভ্রমরগুলি অলঙ্কারের মতো দেবীর দেহে অধিষ্ঠান করতে শুরু করে যা থেকে দেবীর নাম হয় ভ্রামরী।

এই শক্তিপীঠ খুবই জাগ্রত বলে মানুষের বিশ্বাস। দেবী এই পীঠস্থানে ভ্রমর পরিবেষ্টিত কালিকা রূপে বিরাজমানা। মন্দিরে প্রবেশ করলে প্রথমেই রয়েছে দেবীমূর্তি। এখানে দেবী সালঙ্কারা ও অষ্টভূজা। দেবীর সামনে রাখা বড় বড় কলসের উপর রয়েছে পুষ্পপত্র। তার পাশে রাখা আছে পিতলের তৈরি দেবীর চরণদ্বয়। এই চরণদুটিতেই পুজো করা হয়। মন্দিরে তাঁর দক্ষিণ পাশে অবস্থান করছেন দেবাদিদেব মহাদেব ও অনুচর নন্দী । সেই মন্দির কক্ষ থেকে কয়েকধাপ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলেই পৌঁছে যাওয়া যায় ভ্রামরী মাতার মন্দিরের গর্ভগৃহে। যেখানে দেবী সিংহবাহনা। দেবীর গাত্র কৃষ্ণবর্না। তাঁর চার হাতে শোভিত রয়েছে গদা, ত্রিশূল, খড়্গ ও ঢাল । সামনের বেদীতেই থাকে দেবীর প্রস্তরীভূত বামপদ।

Bhramori-ma

মন্দিরটি সারা দিনরাত সর্বদাই খোলা থাকে। এখানে দেবী মায়ের কাছে পূজা দেওয়ার আগে নিকটবর্তী তিস্তা নদীতে স্নান করে পরিষ্কার কাপড় পরার রীতি প্রচলিত আছে। এই মন্দিরে নবরাত্রি উৎসব এবং দুর্গাপূজা মহা আড়ম্বরে পালিত হয়। মাঘী পূর্নিমার পুণ্য তিথিতেও এখানে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সময় প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়ে থাকে।

আবার অন্য একটি মত বলছে ত্রিস্রোতা' কথাটির অর্থ করোতোয়া, তিস্তা, জঠোদা এই তিন নদীর ধারা মিলনস্থান। এর মধ্যে এই পীঠস্থান। এখানে দেবী ভ্রামরী সিদ্ধেশ্বরী রূপে বিরাজিতা এবং অদূরেই রয়েছে পীঠ ভৈরব জল্পেশ্বর। কালিকা পুরাণে দেবী ভ্রামরী বা সিদ্ধেশ্বরীর বর্ণনা পাওয়া যায়। জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়িতে প্রতিষ্ঠিত এই প্রাচীন মন্দিরকে আসল সতীপীঠ ভ্রামরী দেবীর মন্দির বলা হয় অনেক জায়গায়। জল্পেশ্বর মন্দিরের একশো মিটারের মধ্যে এই মন্দিরের অবস্থান। এখানে নাকি দেবীর অঙ্গুলি বিহীন বাম পদ পড়েছিল। বলা হয়ে থাকে এই দেবী-অঙ্গ মন্দিরে এখনো অক্ষুন্ন রয়েছে। এখানে দেবীর গর্ভেশ্বরী এবং গর্তেশ্বরী নামে দুটি প্রাচীন মূর্তি আছে। কালিকাপুরাণে জল্পেশ-এর সিদ্ধেশ্বরী মা ভ্রামরী দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ঠিক কোন স্থানে সতীর পদ পতিত হয়েছিল এ নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও দুটি মন্দিরই দেবীর ভক্তদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ পুণ্যস্থান।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...