বঙ্কিমচন্দ্র: যে গান গিয়েছে হারিয়ে

বঙ্কিমের (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) বয়স তখন বারো-চোদ্দ বছর। অর্থাৎ, ১৮৫১-৫২ সালের কথা। 

তখন দুর্গাপুজোর বিজয়ার দিনই সিঁদুর খেলার পর মায়ের ভাসান হত। নৈহাটির গা ঘেঁষে কাঁঠালপাড়ায় তাঁর বাড়ি। তো, সেবার গঙ্গার বুকে নৌকোয় চেপে  বিজয়ার ভাসান দেখতে গেলেন বঙ্কিম। সঙ্গে ছিলেন বাবা যাদবচন্দ্র, দাদা সঞ্জীবচন্দ্র, ভাই পূর্ণচন্দ্র এবং জ্ঞাতিগুষ্টির আরও কয়েকজন। ভাসানের আগে নৌকো বাইচ হল। তারপর শুরু হল  ডাকের সাজে সজ্জিত ভাসান। ঢাকীদের ঢাকের তালে তালে, ভক্তদের নাচের মাঝে একে একে জলে ডুব দিলেন দেবীপ্রতিমারা। তার অপরূপ শোভা দেখে  ভারি আনন্দ হল বঙ্কিমের। কিন্তু ফেরার পথে এক ধাক্কায় কেটে গেল সেই আনন্দের রেশ। চোখে পড়ল এক মর্মান্তিক দৃশ্য।

গঙ্গার পাড়ে দাউ দাউ করে চিতা জ্বলছে। চিতার সামনে পাগলের মতো কাঁদছে সদ্য বিধবা বউটি। শুধু কাঁদছেই না, বারে বারে হুমড়ি খেয়ে স্বামীর চিতায় উঠে পড়তে চাইছে। শ্মশানযাত্রীদের মধ্যে একটি মেয়ে তাকে জাপটে ধরে আটকে রেখেছে, কিন্তু বউটির গায়ে তখন যেন অসম্ভব পাশবিক শক্তি ভর করেছে! সেই শক্তির জোরে সমস্ত বাধা কাটিয়ে তেড়ে ফুঁড়ে নিদারুণ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে। তার মাথায় সতী হওয়ার ভুত চেপেছে! মাঝখানে চলছে বাঁচামরার লড়াই। লড়াইটা এক সময় থেমে গেল, ধ্বস্তাধ্বস্তির মধ্যে বউটি আচমকা জ্ঞান হারাল।

দৃশ্যটি কিশোর বঙ্কিমের মনে এমনভাবে দাগ কেটে গেল যে, এক করুণ অনুভূতির সৃষ্টি করলো। অনুভবে জন্ম নিল দর্শন। স্বভাব কবির মতোই তক্ষুনি মনে মনে রচনা করে ফেললেন একটি গান,--

'হারালে পায় কি ফিরে মণি--

কি ফণিনী, কি রমণী?'

আপন মনে বিড় বিড় করে তক্ষুনি সুর দিয়ে ফেললেন মল্লার রাগে। গান সম্পূর্ণ হতেই আদি কবির মতোই তিনি চমৎকৃত হলেন, এ কি করেছেন তিনি! উপলব্ধির এই স্তর থেকেই স্রষ্টার মনে জাগল এক পূর্ণ সৃষ্টির আনন্দ। সেই আনন্দ ভাগ না করে পারা যায় না। বড়দের তো আর আদিখ্যেতা করে শোনানো যায় না, তাই পাশে বসা ছোটভাইটিকে কানে কানে গেয়ে শোনালেন সেই গান। বাড়ি ফিরে বেশ কিছুদিন এই গানটি গাওয়ার উৎসাহ কবিকে যেন পেয়ে বসেছিল, তারপর ধীরে ধীরে সেই উৎসাহে একদিন ভাটা পড়ল, আর গানটিও লুপ্ত হল। বড় হয়ে বঙ্কিমের মনে ছিল কিনা কে জানে, তবে তিনি তা আর কোথাও লিখে রাখেননি। পূর্ণচন্দ্র শুধু ওই পংক্তি দুটি মনে করে তাঁর স্মৃতিকথায় লিখে রেখেছিলেন, বাকিটুকু হারিয়ে গেছে। সুর আর গান এক সাথে। বঙ্কিম সাহিত্যজীবনে মাত্র দু'খানা গানই লিখেছিলেন। দ্বিতীয় 'বন্দে মাতরম'-এর কথা তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু, প্রথমটির কথা পূর্ণচন্দ্র না-জানালে, কোনদিন জানতেই পারতাম না।

 

তথ্যঋণ: বঙ্কিমের বাল্যকথা- পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...