এক অভিনব উদ্যোগ নিয়ে সাইকেল চালিয়ে বিশ্বের ১৯১টি দেশ ঘুরলেন সুন্দরবনের সোমেন!

বাঙালিরা সবকিছু করতে পারে। কথায় আছে, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডি পাঠ, সবকিছুতেই দুর্দান্ত কাজ করে দেখিয়ে দেয় প্রত্যেক বাঙালি। এবার সেই তালিকায় পা দিল সুন্দরবনের বাসন্তীর যুবক, সোমেন দেবনাথ। কি করেছেন তিনি? শুনলে অবাক হয়ে যাবেন।

সাইকেল চালিয়ে সারা বিশ্ব ঘুরলেন তিনি। দেশের ১৯১টি দেশ ঘুরে ১৯ বছর পর বাড়ি ফিরলেন তিনি। শুনে অবাক হচ্ছেন তো? কিন্তু কেন? চলুন জেনে নেওয়া যাক।

সোমেন এইডস নিয়ে সারা বিশ্বকে সচেতন করতে সাইকেলে করে একের পর এক দেশে পাড়ি দিয়েছেন তিনি। সাতটি মহাদেশের ১৯১ টি দেশ ঘুরে ১৯ বছর ৭ মাস বাদে বাড়ি ফিরেছেন তিনি।

WhatsApp Image 2023-12-21 at 16.36.38

তাঁর ১৯১ তম দেশ ছিল বাংলাদেশ। সেই সফর শেষ করে দমদম বিমান বন্দরে ফেরেন সোমেন। সেখানে তাঁকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন তাঁর পরিবার, আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধব।

চোদ্দ বছর বয়স থাকাকালীন এইচ আই ভি-তে এক ব্যক্তির মৃত্যুর খবর সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারার পর থেকেই এই রোগ সম্পর্কে আরও জানার আগ্রহ জাগে তাঁর মধ্যে। সেখান থেকেই শুরু। মনের ভেতর জেদ চেপে যায় একটা!

স্কুলের পড়াশুনা শেষ করেই এইডস নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন সোমেন। তিনি প্রতিরোধের জন্য রিজিওনাল এইডস কন্ট্রোল সোসাইটি থেকে স্পেশাল ট্রেনিং করেন। এরপর সমাজকে এই মারণ রোগকে সচেতন করতে এই অভিনব উদ্যোগটি নিলেন তিনি। তাই প্রাণীবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করে বি এ তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ হতেই, শুরু করে দেন সেই অভিযান।  

২০০৪ সালের ২৭ মে এইচ আই ভি এইডস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে সাইকেলে চেপে বাড়ি থেকে রওনা দেন বাংলার সোমেন। এরপর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে এবং পাশাপাশি প্রতিবেশী বেশ কয়েকটি দেশে প্রচার সেরে বাড়ি ফেরেন।

প্রথমেই এশিয়া মহাদেশের অন্তর্গত ২৪ টি দেশ ঘোরার পর, ইউরোপে পাড়ি দিয়েছিলেন সোমেন। সেখানে তিন বছর থেকে ৪৫টি দেশে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতার বার্তা দেন।

২০১২ সালে তিন মাসের জন্য গ্রিনল্যান্ডে যান। সেখান থেকে সেই বছরের শেষের দিকে বেড়িয়ে আফ্রিকা মহাদেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন তিনি। দক্ষিন আফ্রিকা, ব্রাজিল ঘুরে আন্টারটিকা পৌঁছন সোমেন। এরপর সেখান থেকে পানামা, মেক্সিকো হয়ে আমেরিকা। সব শেষে তিনি এশিয়া মহাদেশের বাকি থেকে যাওয়া দেশগুলিতে প্রচার সেরে নিজের দেশে ফিরলেন বাংলার যুবক।

সোমেন মূলত এইডসের সচেতনতার বার্তা সমস্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন ধরণের সামাজিক সংগঠন, সমাজসেবী প্রতিষ্ঠানগুলিতে গিয়ে গিয়ে দিয়েছেন। তাঁর পুরো যাত্রা পথে বিভিন্ন ধরণের বৈচিত্রের মানুষের সাথে দেখা হয়েছে, কথাও হয়েছে। 

জানা গিয়েছে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রদূতরা, প্রবাসী ভারতীয়রা তাঁর পাশে থেকে সাহায্য করেছেন। তাঁকে এই কাজে সাহস জুগিয়েছেন তাঁরাই।

সোমেনের মতে যদি তাঁর এই কাজে কোনও একজন মানুষেরও উপকার হয় তাহলেই তিনি সফল হবেন। তিনি এই যাত্রা পথে সাইকেলে চেপে প্রায় দু লক্ষ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছেন। এছাড়া তিনি ২০ মিলিয়নের বেশি মানুষের সঙ্গে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন, এইচআইভি সম্পর্কে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন তাঁদের কাছে। 

বাসন্তী আসল ঠিকানা হলেও বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা ও দুই ভাইকে নিয়ে সোনারপুরে থাকেন সোমেন। জানা গিয়েছে সোনারপুর সংলগ্ন সুভাষগ্রাম এলাকায় একটি জায়গায় সংগ্রহশালা ও গ্লোবাল ভিলেজ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে যুবকের।

সেখানে তিনি বিশ্বভ্রমণ করে পাওয়া জিনিসপত্র সংগ্রহশালায় রাখবে এবং অন্যদিকে গ্লোবাল ভিলেজ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এইডস আক্রান্তদের পাশে থাকার জন্য কাজ করা হবে। পাশাপাশি তাঁর দাবি সারা বিশ্বের মানুষের একটা মিলনস্থল গড়ে তোলা সম্ভব হবে এখানে।

তবে এখন কিছুদিন বিশ্রাম নেবেন তিনি। এমনটাই জানিয়েছেন তিনি। বিশ্বভ্রমণের নানা স্মৃতি নিয়ে বই লেখার কাজে হাত দিয়েছেন সোমেন, সেই কাজটাই এখন শেষ করতে চান তিনি।

তিনি জানিয়েছেন যে এই পথ অতিক্রম করতে গিয়ে তাঁকে তালিবানিদের হাতে বন্দি থাকতে হয়েছে এবং তাঁদেরকে দিনের পর দিন রান্না করে খাওয়াতে হয়েছে। অন্যদিকে, গ্রীনল্যান্ডে এস্কিমোদের সঙ্গে থেকেছেন, কেনিয়ায় মাসাইদের সঙ্গে বাস করেছেন। এছাড়াও শ্রীলঙ্কায় এলটিটি জঙ্গীদের সঙ্গে রাত কাটিয়েছেন তিনি। শুধু এখানেই শেষ নয়, চিনে করোনা অতিমারিতে আক্রান্ত হয়ে মরতে মরতে বেঁচেছেন সোমেন। নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে এই যাত্রাপথে অতিক্রম করতে গিয়ে। সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই বই লিখছেন বাংলার ছেলে, সোমেন।

পরিবারের সকলেই খুব খুশী সোমেনকে এতদিন পর দেখে। আপাতত সোমেন সুভাষগ্রামে রয়েছেন তাঁদের পিপিল হাউসে। জানা গিয়েছে আগামী ১৭ই ডিসেম্বর ক্যানিং থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে পৌঁছবেন নিজের জন্মভূমি, বাসন্তীতে। জানা গিয়েছে, ঐদিন সুন্দরবন সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষ যোগ দেবেন তাঁর সাইকেল যাত্রায়। এছাড়াও নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে তাঁকে ঘিরে। এইভাবেই সোমেনকে স্বাগত জানাবে সুন্দরবন।

বিদেশের বহু বন্ধু-বান্ধবীরা তাঁর সাথে দেখা করতে আসছেন বাংলায়। এদের সাথে বিশ্ব ভ্রমণের যাত্রাপথে বন্ধুত্ব হয়েছিল সোমেনের। ইতিমধ্যেই জানা গিয়েছে ওমানের রাজকুমারী নাদ্যা এসেছেন সুভাষগ্রামে সোমেনকে দেখতে । 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...