“উত্তমদা যেন মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল” — তাহলে কি হয়েছিল আসলে মৃত্যু নাকি সুইসাইড!

মহানায়ক উত্তম কুমার তাঁর মৃত্যুর আগে সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন যে তিনি আর বেশি দিন নেই। তাঁর কিছু ঘটনা রয়েছে যেখান থেকে বোঝাই যাচ্ছিল তিনি তাঁর মৃত্যুর বিষয় নিয়ে আগে থেকেই সব কিছু জানতেন।

১৯৭৫ সালের দিকের ঘটনা। স্টুডিয়ো পাড়ায় টানা লোডশেডিং-এর দরুণ শুটিং-এ সমস্যা হওয়ার কারণে মহাকরণে সেই সময়ের বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন সত্যজিৎ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং উত্তমকুমার।

তখন গাড়িতে যেতে যেতে মহানায়ক উত্তম কুমার বললেন, “মানিকদা, আপনি কিন্তু আমাকে আর নিচ্ছেন না।”

সেই প্রশ্নের উত্তরে, সত্যজিৎ রায় বললেন, “দেখো উত্তম, তোমার বয়সটা এখন এমন, তুমি না বুড়ো না জোয়ান। আরেকটু বুড়ো হলে তোমাকে নেব।”

তাঁরপর উত্তম বললেন, “বুড়োর পার্ট আর করা হবে না আমার, ওসব পুলুই করবে।” সৌমিত্রর ডাকনাম ছিল পুলু।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে এই ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, “উত্তমদা যেটা বলল সেটাই সত্যি হয়ে গেল। আশ্চর্য! উত্তমদা যেন মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল। প্রায়ই বলত, আর ভাল্লাগছে না রে! আর ভাল্লগাছে না!”

আর এক ঘটনা। কলকাতায় মেট্রো চালু হয় আটের দশকের মাঝামাঝি। ৭৮-৭৯ সাল নাগাদ মেট্রোর জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, রাস্তাঘাটে মারাত্মক খারাপ অবস্থা। এমনই একদিন জ্যামে দাঁড়িয়ে আছেন উত্তমকুমার এবং গাড়িতে তাঁর সঙ্গে রয়েছিলেন এক সহশিল্পী। সে বলল, “দাদা, মেট্রো যখন চালু হবে তখন কলকাতাঁর চেহারাটাই পালটে যাবে।” উত্তম একটা অদ্ভুত উত্তর দিয়েছিলেন। “ওসব আর আমার দেখা হবে না রে! ওসব তোরাই দেখিস।”

মহানায়ক উত্তম কুমার তাঁর ঘনিষ্ঠদের কাছে মাঝেমধ্যেই বলতেন, “এবার একা থাকব। কিচ্ছু ভাল্লাগছে না!”

একবার অভিনেতা রবি ঘোষ উত্তমকুমার সম্পর্কে লিখেছিলেন, যে- “উত্তমকুমার এত বড় নায়ক, লক্ষ কোটি তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্ত, সবাই তাকে ভালবাসে, তাকে ছুঁতে চায়। কিন্তু উত্তম? অবাক হয়ে দেখতাম, উত্তম যখন একবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি হল, তখন সারাদিন চাতক পাখির মতো চেয়ে বসে থাকত কখন মা আসবেন তাকে দেখতে। সেই আকুলতা দেখে মনে হত মানুষটা বড় অসহায়। জগৎসংসারে যেন কেউ নেই, এমন যাকে ভরসা করা যায়, বিশ্বাস করা যায়।”

উত্তমকুমার যেদিন মারা গেলেন, সেই রাতে কলাকুশলীদের আর অসংখ্য গুণমুগ্ধ মানুষের ভীড় জমে গিয়েছিল! সেখানে, সেই সব মানুষের ভিড়ের মধ্যেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন আর বলেন, “বুড়োদা, ও মুখ আমি কেমন করে দেখব গো! এ তো ক্যালকুলেটিভ সুইসাইড! যার হার্টের অবস্থা ভাল না, যার রেস্ট প্রয়োজন, সে রাত দুটো পর্যন্ত মদ খায়, পার্টিতে হইহই করে সব জেনেশুনে? উত্তমদা এ কী করলে?”

২৩ জুলাই শুটিং থেকে ফিরে উত্তম গিয়েছিলেন প্রযোজক দেবল ঘোষের নতুন ফ্ল্যাটে গৃহপ্রবেশের পার্টিতে। গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে মদ্যপান করে ভোররাতে বাড়ি ফেরেন। ২৪ জুলাই সকাল সাড়ে পাঁচটা- ছটা নাগাদ অভিনেত্রী সুপ্রিয়ার কন্যা, সোমার সঙ্গে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলেন উত্তম। অন্যদিনের থেকে বেশি ঘামছিলেন তিনি। তাকে দেখে সোমা বললেন, “বাবি, তুমি খুব ঘামছ!”

উত্তম বললেন, “হুম। বুকেও একটু চিনচিন করে ব্যথা করছে। আমি বরং একটু বেলভিউ থেকে ঘুরে যাই।”

এই বলে উত্তম হেঁটে হেঁটেই বেলভিউ পৌঁছে যান।

রাত ৯:৩২-এ প্রয়াত হন মহানায়ক উত্তম কুমার। ভবানীপুরের বাড়িতে, তাঁর প্রিয় অ্যাম্বাসাডরে করে তাঁর মরদেহ আনা হয়েছিল। তাঁর শেষ ডায়েরিটির পাতাগুলোয় দেখা যাবে, সবুজ কালি দিয়ে ২৩, ২৪, ২৫ জুলাই, ১৯৮০-এর পাতায় লিখে রেখেছেন- “ডাবিং ওগো বধূ” আর ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ সিনেমাটির নাম কাটা। ২৬ জুলাই থেকে পরপর কটা পাতায় লেখা, ‘রেস্ট’! চিরবিশ্রাম!

কেউ এই ব্যাপারে কিছুই বুঝতে পারেননি। কে জানে, তিনি হয়তো নিজেই চেয়েছিলেন এটা হোক!

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...