মনে পড়ে কল্পনা- মেনকাদের ?

উজ্জ্বলা, প্রাচী, পদ্মশ্রী, বিজলী, জয়া, মিনি-জয়া প্রিয়া, মেনকা’দের মনে আছে?
না বান্ধবীদের নাম নয় !
বিশ বছর আগে কলকাতা আর শহরতলির সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমা হলগুলোর নাম একবার মনে করে দেখুন তো!
ফি শনিবার পরিবার নিয়ে ম্যাটিনি শো’এ সিনেমা দেখা, ইভনিং শো’তে স্কুল ফেরত প্রেমিক প্রেমিকার প্রথমবার হাতে হাত ধরে শাহরুখের প্রেমে পড়া, একসঙ্গে!
বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে শাশুড়ির জিম্মায় রেখে কপোত কপোতীর নাইট শো দেখে ফিরতি পথে চাউমিন, রোল , ফুচকা খেয়ে বাড়ি ফেরা!
ছুটির দিনে দুপুরগুলো তাড়াতাড়ি হাতের কাজ সেরে, খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে কোনোমতে এঁঠো বাসন জড়ো করে পাটভাঙ্গা নতুন তাঁতের শাড়ি পড়ে মাসিমা, কাকিমা, জেঠিমাদের হইহই করতে করতে “গুরুদক্ষিণা”।
লেকটাউনের জয়া-তে সবই যেন চেনাচেনা মুখ! পাশের বাড়ির ঝিমলি থেকে পাশের পাড়ার বাবাই..সবাই মায়ের পিছন পিছন বাধ্য সন্তানের মত ‘প্রেম প্রতিজ্ঞা’ দেখতে এসেছে। মিঠুনের লাল ফিনফিনে শার্টের তলায় গোলগোল ফুঁটো ফুঁটো গেঞ্জির অত্যাচার ঠেকানো যায়নি!
আসলে সে সময় সিনেমা তো শুধু দেখা ছিল না, সিনেমা চাখা হত। মাধ্যম এই সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমা হলগুলো। টিকিট দেখিয়ে টর্চের আলোর ইশারায় রিসার্ভড সিট খুঁজে নেওয়ার মধ্যে যেন কী এক নিষিদ্ধ রোমাঞ্চের স্বাদ!
সিনেমা শুরু হওয়ার আধঘন্টা আগেই দখল হয়ে যেত সিট। টিকিট কেটেও আগে গেলে আগে পাবার তারা। কিসের যে তাড়া নির্দিষ্ট উত্তর কারও কাছেই বোধহয় থাকত না। তবে আরও যেন এক সিনেমা চলত সেখানে।
পয়সা দিয়ে টিকিট কেটেছে তাই সোডা, সিগারেট, কাপড় কাচার সাবান, “সান্তুর মম” এসব বিজ্ঞাপন যাতে মিস না হয়ে যায় তাই আগেভাগে আসা!
পায়ের ওপর পা দিয়ে “সরি দাদা” বলে অন্ধকার হলে নিজের জায়গা খুঁজে নিয়ে বসেই মনে পড়ে যাওয়া, পপকর্ন খেতে হবে, বাসি তেলে ভাজা পটেটো চিপস,থামস আপ, ঝালমুড়ি নারকেল দিয়ে ... উফফফ কখন আসবে চানাচুরওয়ালা!
সিনেমার স্বাদ আসলে ওই মুখরোচকের লিস্টের মতন জিভে লেগে থাকতো! সে স্বাদ তো ভোলা অসম্ভব!
তার মধ্যে বিশেষ টিপ্পনি!
“ সিনেমা কই! খালি তো কথার সাগর!
কোনও নাচ নেই, গান নেই! ধুস!”
“অসুখ” সিনেমাটি দেখতে দেখতে একজন পিছনের সিটে বসে চ্যাকরচ্যাকর পান চিবোতে চিবোতে বললেন, “খালি বাবা আর মেয়ে খাবার গরম করে আর খায়! খেয়েই চলেছে”
ব্ল্যাকে টিকিট কিনে একদম সামনের সারিতে বসে বকের মতন ঘাড় লম্বা করে “বাজিগর” দেখে সিনেমার শেষে শাহরুখের মৃত্যুদৃশ্য দেখে কাঁদতে কাঁদতে মেনকা সিনেমা হলের বাইরে এসে একটার জায়গায় দুটো টিকিয়া রোল খেয়ে দুঃখ একটু কম হয়েছে।
এক গামলা বাটার, ক্যারামেল, চকলেট দেওয়া দুশো টাকার পপকর্ন খাইয়ে সেই স্বাদ মাল্টিপ্লেক্স কোনোদিন দিতে পারেনি! পারেনি সিঙ্গেল স্ক্রিনে “গুরুউউ” বলে পয়সা ছুঁড়ে দেওয়ার স্বাধীনতা দিতে!
বেলাগাম উচ্ছাস,হাততালির আওয়াজ, “সিটি” দিতে দিতে মিঠুনের ডিস্কো মুভসের তালে তাল মিলিয়ে ভক্তদের উদ্দাম নাচকে জায়গা করে দিতে... সিঙ্গেল স্ক্রিন গোটা পরিবারের আট থেকে আশি সব্বাইকে এক সঙ্গে নিয়ে একটা যৌথ পরিবার গড়ে তুলেছিল, যেন এক চালার চলচিত্র উৎসব. মানুষ ওই সস্তা চেয়ারে বসে যে সাবলীল আনন্দের মুহূর্ত পেয়েছে, স্মৃতি কুড়িয়েছে তা মাল্টিপ্লেক্সে রিক্লাইনারে শুয়ে গায়ে কম্বল চাপা দিয়ে আর হয়নি, সেই ইচ্ছেটুকুই দমচাপা পড়ে গিয়েছে. এতো দামি পরিবেশে মন কুণ্ঠায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে বড্ড তাড়াতাড়ি।
পুরোনো শহরের পুরোনো সিনেমা হলগুলো একটা একটা মরে যায়। তাদের মেরে ফেলা হয় বাণিজ্যিকীকরণের দাবড়ানিতে! কিন্তু আজও ইউটিউবে মানুষ খুঁজে খুঁজে ওই ৪৪-৬০ এমএমের ছোপছোপ পুরোনো স্ক্রিনে দেখা সিনেমাগুলোই দেখে, একা বসে নিজের মনে হাসে, কাঁদে!
ভ্যাপসা গরম, স্যাতস্যাতে অন্ধকারে তৈরি হওয়া ভালোলাগার মুহূর্তগুলো হয়তো এভাবেই বাঁচিয়ে রাখে মানুষ |
বান্ধবীদের নাম না হলেও আসলে ওই ছোপ ধরা ছোট স্ক্রিনের সিনেমা হলগুলো ব্যস্ত শহরের খুব ভালো ভার্চুয়াল বন্ধুই ছিলো! খুব নিজ্বস্ব, অসাধারণ ভালোবাসা!

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...