সতীপীঠঃ চৈত্র-উৎসবে সন্তানহীনা নারীরা কৃপাপ্রার্থী হন নাসিকের ‘সপ্তশৃঙ্গী দেবী’মাতার দরবারে

মহারাষ্ট্রের নাসিক। সেখান থেকে ষাট কিলোমিটার দূরে ছোট্ট একটি গ্রাম, নান্দুরি। এখানেই রয়েছে একান্নপীঠের অন্যতম এক সতীপীঠ। পীঠস্থানটি রয়েছে একটি সুউচ্চ পাহাড়ের উপর। এই পীঠস্থানকে ‘সাড়ে তিন শক্তিপীঠ’-এর অন্যতম পীঠও বলা হয়। এখন প্রশ্নও হচ্ছে, এই পীঠকে এমন বলার কারণ কী? আসলে, কিংবদন্তি অনুসারে মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে চারটি সতীপীঠের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। এই চারটি পীঠ হল, কোলাপুরের ‘মহালক্ষ্মী মন্দির’, তুলজাপুরের ‘তুলজা ভবানী মন্দির’, মোহরের ‘রেণুকা মন্দির’ এবং নাসিকের নান্দুরি গ্রামের এই আলোচ্য মন্দিরটি। এদের মধ্যে তিনটিকে পূর্ণপীঠ এবং একটিকে উপপীঠ হিসেবে ধরা হয়। তাই এই চারটি পীঠকে একত্রে ‘সাড়ে তিন শক্তিপীঠ’ বলা হয়। আমাদের আলোচ্য অর্থাৎ নান্দুরি গ্রামের পাহাড়স্থিত পীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে বলা হয়, ‘সপ্তশৃঙ্গী দেবী’।

দেবীর নাম ‘সপ্তশৃঙ্গী’ হওয়ার প্রধান কারণ হল, দেবীর পীঠস্থানের অবস্থান। ‘সপ্ত’ মানে, সাত; ‘শৃঙ্গ’ মানে, পাহাড় বা পর্বতের চূড়া। দেবী যে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান করছেন, সেটি সপ্ত-সংখ্যক চূড়া। আর এই সপ্তম চূড়াটিকে ঘিরে রয়েছে বাকি ছয়টি চূড়া। সে-এক অপূর্ব সহাবস্থান। দেবী সপ্তম চূড়ায় অবস্থান করছেন বলে, দেবীকে স্থানীয় মানুষেরা ‘সপ্তশৃঙ্গনিবাসিনী দেবী’ নামেও সম্বোধন করেন।

কিংবদন্তি অনুসারে, দেবী এই পীঠস্থানে আদি থেকেই রয়েছেন। কেননা, দেবী স্বয়ং ‘ব্রহ্মস্বরূপিনী’। পিতামহ ব্রহ্মার কমণ্ডলু থেকে তিনি স্বয়ং নিজেকে সৃষ্টি করে আবির্ভূত হন। আবির্ভাবের পর পিতামহকে তিনি তাঁর জন্য একটি পবিত্র বাসস্থান নির্দিষ্ট করে দিতে বলেন। তখন ব্রহ্মা সপ্তশৃঙ্গের অন্যতম এই শৃঙ্গস্থল পবিত্র বিবেচনায় তাঁকে অধিষ্ঠানের জন্য অনুরোধ করেন। এই সপ্তশৃঙ্গ পাহাড়প্রদেশে পূর্বে ছিল সঘন ও নির্জন তপোবনসুলভ অরণ্য; সেইসঙ্গে ছিল একশো আটটি পবিত্র কুণ্ড। এই কুণ্ডগুলো এখনও ভক্তজনের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ও দর্শনীয় তীর্থ হয়ে রয়েছে। তাদের কয়েকটির নাম, ‘জলগুম্ফা’, ‘কালীকুণ্ড’, ‘শিবতীর্থ’, ‘সূর্যকূণ্ড’ প্রভৃতি। যাই হোক, অতীব রমণীয় হওয়ায় এই স্থান দেবীর অত্যন্ত পছন্দ হয়। এবং দেবী এখানেই বসবাস করতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে দেবীর এক ‘অংশ’ যখন দক্ষকন্যা সতীরূপে জন্ম নেন এবং স্বামী শিবের অপমান সহ্য করতে না-পেরে আত্মহুতি দেন; তখন ভগবান বিষ্ণু সতীর মৃতদেহকে একান্ন টুকরোয় বিভক্ত করেন। এই একান্ন টুকরো পৃথিবীর যেখানে যেখানে পড়ে, সেখানেই এক একটি সিদ্ধ ও পূর্ণ সতীপীঠ গড়ে ওঠে। সপ্তশৃঙ্গে একান্ন টুকরোর মধ্যে সতীর দক্ষিণ বাহু পতিত হয়েছিল। সপ্তশৃঙ্গের সতীপীঠে যেহেতু আগে থেকেই দেবী ‘শক্তি’ সপ্তশৃঙ্গীর অধিষ্ঠান ছিল, তাই তিনিই হলেন এই পীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।

দেবীর মূর্তি সুবিশাল। প্রায় আট থেকে দশ ফুট উঁচু। পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে এই মূর্তি নির্মাণ করা হয়েছে। তাই মূর্তি পাহাড়ের গায়ের সঙ্গেই লগ্ন হয়ে আছে। স্বরূপে দেবী হলেন, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। কিংবদন্তি অনুসারে, দেবীর মূর্তিটি কোন মানুষের খোদাই করা নয়, এই মূর্তি নিজে থেকেই সৃষ্টি হয়েছে অর্থাৎ দেবীর এই মূর্তি স্বয়ম্ভূ। স্বয়ম্ভূ এই মূর্তি সাধারণের গোচরে কীভাবে এলো? এর পেছনেও আছে একটি গল্প। সেই গল্পে বলা হচ্ছে যে, যেখানে দেবীর মূর্তি রয়েছে, কোন এক সময় সেখানে একটি বড় মৌমাছির চাক তৈরি হয়; একজন মধু-সংগ্রহকারী সেই চাক ভাঙতে গিয়ে সর্বপ্রথম দেবীর মূর্তি আবিষ্কার করে এবং তারপর দেবী সাধারণের গোচরে আসেন, দেবীর নিত্যপূজা শুরু হয়।

যাই হোক, ফিরে আসি দেবীমূর্তির রূপের কথায়। দেবীর মূর্তি রণংদেহী। তাঁর আঠারোটি হাত। সকল হাতের রয়েছে আয়ুধ। তার মধ্যে রয়েছে শিবের ত্রিশূল, বিষ্ণুর চক্র, শঙ্খ, তির-ধনুক, যমদণ্ড, কমণ্ডলু, পরশু, পদ্ম প্রভৃতি। দেবীর সর্বাঙ্গ গৈরিক সিঁদুরে মণ্ডিত। কপালে রঙ দিয়ে ‘ওঁ’ লেখা। দেবীর ভ্রু কালো রঙে ধনুকের আকারে আঁকা। খোদিত আসল ভ্রু রয়েছে তার একটু নীচে, সেটা কিন্তু অতটা বঙ্কিম নয়। দেবীর নাসিকা টিকলো। তাতে রয়েছে মহারাষ্ট্রীয় কল্কা আকারের নথ। দেবীর চোখ যেন পটলচেরা, সাদা-কালো রঙে আঁকা। দৃষ্টি দূরে, কিন্তু তীব্র, তবুও তাতে ভক্তের জন্য আশ্রয় রয়েছে। দেবীর মুখমণ্ডল সুগোল নয়, কিছুটা যেন বাংলার আটপৌরে দুর্গা প্রতিমার মতো ঢল ঢল। গ্রীবা ঈষৎ বামে বঙ্কিম। দেবীর মাথায় রত্নমুকুট। কানে ফুল ও রত্নের কুণ্ডল। গলায় ফুলের মালা ও রত্নহার। দেবীকে বিশেষ পদ্ধতিতে বসন ও বক্ষাবরণ পরানো হয়। দেবীর দুটি পায়ের পাতা রুপো দিয়ে মোড়ানো। দেবীর বেদি ও মণ্ডপ অলঙ্কৃত রুপোর পাত দিয়ে দরবারের মতো সুন্দর করে সাজানো। দেবীর আসল পা ভক্তেরা স্পর্শ করতে পারেন না। তারাপীঠে যেমন ভক্তেরা রুপোর পৃথক পাদপদ্মে মাথা নত করে দেবীকে শ্রদ্ধা জানান, এখানেও অনুরূপ ব্যবস্থা রয়েছে। দেবীর বেদি থেকে দূরে রয়েছে ধাতব মহিষের মাথা রূপে মহিষাসুরের প্রতীক।

কিংবদন্তি অনুসারে, এই দেবী সপ্তশৃঙ্গী স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্রের দ্বারা পূজিতা হয়েছিলেন। দেবীর অধিষ্ঠান যে-পাহাড়ে, সেখানে পূর্বে যে অরণ্য ছিল, তাই-ই ছিল ‘দণ্ডকারণ্য’ নামে প্রসিদ্ধ। দেবী সীতাকে নিয়ে অরণ্য-চারণ করতে করতে শ্রীরামচন্দ্র এই পীঠে উপস্থিত হয়েছিলেন। এখানে দেবী শক্তির উপস্থিতি অনুধাবন করে স্বহস্তে দেবীর পূজা করে কৃপালাভ করেছিলেন। কথিত আছে যে, যুদ্ধে লক্ষ্মণ যখন লঙ্কায় হতচেতন হয়ে পড়েছিলেন, তখন হনুমান বিশল্যকরণীর সন্ধানে দেবীর এই পীঠপাহাড়েই হাজির হয়েছিলেন।  

দেবীর পূজায় কিছু বিশিষ্টতা আছে। যেমন, অভিষেককালে দেবীকে পঞ্চামৃত (মধু, চিনি, দুধ, দই ও ঘি) সহযোগে কবোষ্ণ জলে স্নান করানো হয়। দেবীর শৃঙ্গার হয় নিত্য নতুন বস্ত্র দিয়ে। দেবীকে নারকেল নিবেদন করেও পূজা দেওয়া যায়, তবে দেবীর পছন্দের নৈবেদ্য হল ‘তুরিস’। এটি মাখন ও ময়দা দিয়ে নির্মিত একটি বিশেষ পিঠা। রাত্রে দেবীর সম্মুখে একটি বিশেষ লোকসম্প্রদায় বিভিন্ন রকমের তন্ত্রী-লোকবাদ্য সহযোগে নৃত্যগীত পরিবেশন করেন। ভক্তজন এই অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ পান। এই নৃত্যগীতকে বলা হয়, ‘গোন্ধল’। স্থানীয় কাঠার বা কুটাডি সম্প্রদায়ের কারও বাড়িতে সন্তান জন্মগ্রহণ করলে ‘নামকরণ’ অনুষ্ঠানের সময় তারা সেই সন্তানের মঙ্গলকামনায় দেবীর থানে ছাগ বলি দিয়ে পুজো দেয়। মন্দিরে সকাল ছ’টা থেকে সন্ধ্যে ছ’টা পর্যন্ত যে-কোন সময় গিয়ে দেবীদর্শন করা যায়, পূজা দেওয়া যায়।

যে-পাহাড়ের উপর দেবীর পীঠমন্দির রয়েছে, তার উচ্চতা ১২৩০ মিটার। এতটা উচ্চতা অতিক্রম করে আগেকার দিনে বয়স্ক মানুষের পক্ষে দেবীর মন্দিরে গিয়ে দেবীদর্শন করা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল; কিন্তু বর্তমানে পথ অনেক সুগম হয়েছে। ১১৫০ মিটার অব্দি পাহাড়ের গা-বরাবর গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত রাস্তা তৈরি হয়েছে। তবে এর পরেও মন্দিরে পৌঁছতে যে-টুকু পথ অতিক্রম করতে হয়, তাতে পাঁচশোটি সিঁড়ি চড়তে হয়। সিঁড়ি চড়তে সময় লাগে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতো। এটুকু অতিক্রম করে মূল মন্দির-চত্বরে পৌঁছলেই যাত্রাপথের কষ্ট আর কষ্ট বলে মনে হয় না। মন্দিরের অপূর্ব বিন্যাস, তার সজ্জা, কারুকাজ; সর্বোপরি দেবীর অপরূপ রূপ দর্শন করে সমস্ত কষ্ট নিমেষে দূর হয়ে মনপ্রাণ যেন একেবারে ভরে যায়।  

মন্দিরের ভেতরটি আসলে গুম্ফা আকারে নির্মিত, সেখানে রয়েছে প্রচুর প্রস্তরস্তম্ভের সমাহার। গর্ভগৃহের মাথার উপর রয়েছে সুউচ্চ শুভ্র চূড়া। চূড়ায় রয়েছে পতাকা। বিশেষ দিনে বিশেষ এক পরিবারের মানুষেরই রয়েছে এই পতাকা উত্তোলনের অধিকার। পতাকা উত্তোলনের এই বিশেষ নিয়মটি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পতাকা-উত্তোলনের রীতিটিকেই যেন স্মরণ করায়। পুরীর মন্দিরের মতোই এই দেবীর মন্দিরের পতাকা বা ধ্বজা উত্তোলনের সাক্ষী হওয়ার জন্যও হাজার হাজার ভক্তের সমাগম হয়।

সপ্তশৃঙ্গী দেবীর মন্দিরে নিত্যপুজোয় প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়। বিশেষ পূজা ও উৎসবের দিনগুলিতে ভারতের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে এত ভক্তজন আসেন যে, তিলধারণের স্থান থাকে না। চৈত্র মাসের প্রথমদিনে অনুষ্ঠিত হয় ‘গুধিপাডবা’ উৎসব। চৈত্র মাসের রামনবমী থেকে পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় ‘চৈত্র-উৎসব’। এই উৎসবের একটি বিশিষ্টতা আছে, এই সময় সন্তানহীনা নারীরা দেবীর থানে হত্যে দিয়ে সন্তান কামনা করে দেবীর কৃপা প্রার্থনা করতে আসেন। এ-থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, দেবী মহিষাসুরমর্দিনীরূপে পূজিতা হলেও সন্তানদাত্রী ও সন্তানের মঙ্গলকারিণী দেবী রূপেই আরাধিত হন। জন্মাষ্টমী উৎসবটি ‘গোকুল অষ্টমী’ নামে খুব ধুমধামের মধ্য দিয়ে এখানে পালিত হয়। অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় ‘নবরাত্রি’ উৎসব। এছাড়াও ‘কোজাগরী পূর্ণিমা’, ‘দীপাবলি লক্ষ্মী পূজা’ ও ‘মহাশিবরাত্রি’ উৎসবও এই মন্দিরে বেশ সাড়ম্বরে পালিত হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...