লক্ষ্মীর স্বরূপ ও ভগবানের গোপন তত্ত্ব

আমাদের সনাতন ধর্মের মধ্যে পুরাণ হচ্ছে আঠারোটি। তার মধ্যে পঞ্চদশ পুরাণ হল কূর্ম পুরাণ। এই কূর্ম পুরাণে দেখা যায়, মহর্ষিদের প্রশ্নের উত্তরে রোমহর্ষণ নামের ঋষি পুরাণ সংহিতার বিষয় ও ভগবানের মুখ থেকে শোনা সমস্ত তত্ত্ব কথা বলতে শুরু করেন। এই কূর্ম পুরাণেই  প্রথমে বিশালাক্ষী দেবীর উদ্ভব কথা এবং পরে ১৮ টি পুরাণ কথা বলার পর পরম তত্ত্ব ও বিভূতি বিষয়ক আলোচনা করা হয়েছে। ভগবান নারায়ণের শ্রীমুখ থেকে বিশালাক্ষী দেবীর কথা শোনার পর উপস্থিত মুনিরা কাল ক্ষয়ের পরের ঘটনা জানতে চান। ভগবান বিষ্ণু তখন বলতে শুরু করেন সেই ঘটনা আর ভগবানের মুখনিঃসৃত সেই বাণী মহর্ষিদের বলে শোনান রোমহর্ষণ ঋষি। 

ইন্দ্রদ্যুম্ন নামের একজন বিখ্যাত রাজা ছিলেন, যিনি ভগবান বিষ্ণুর তপস্যা করে ভগবানের থেকে আদি গুহ্য তত্ত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং পরজন্মে ব্রাহ্মণ রূপে জন্মগ্রহণ করে ছিলেন।  ব্রাহ্মণ রূপে জন্মগ্রহণ করার পর ইন্দ্রদ্যুম্ন ভগবান পরমেশ্বরের উপাসনা করতে শুরু করেন ও ব্রত উপবাস পালন করতে থাকেন। ইন্দ্রদ্যুম্ন বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্মী দেবীকে তার প্রকৃত স্বরূপ জিজ্ঞাসা করলে লক্ষী দেবী ভগবান বিষ্ণুকে স্মরণ করে নিজের প্রকৃত স্বরূপের কথা বলেন এবং জানান তিনি পরমব্রহ্ম এবং পরমেশ্বর। তিনি নারায়ণের সঙ্গে অভিন্না, স্বরূপময়ী এবং পরমা মায়া। ইন্দ্রদ্যূম্ন এই কথা শুনে মাথা নীচু করে দেবীকে প্রণাম করে বললেন সেই নিত্য লীলাময়, অচ্যুত ভগবান পরমেশ্বরকে কী প্রকারে জানব? ব্রাহ্মণের কথায় তখন দেবী বললেন, নারায়ণ স্বয়ং তার প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে তাকে এই বিষয়ে উপদেশ দেবেন। এরপর ব্রাহ্মণ ইন্দ্রদ্যুম্ন বিষ্ণুর আরাধনা করতে থাকলেন, তিনি সমাধি অবলম্বন করলেন।  বহুকাল পরে ব্রাহ্মণের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে জগন্ময় হরি দেখা দিলেন। ভগবানকে সম্মুখে দেখে ইন্দ্রদ্যুম্ন স্তব করতে লাগলেন। তিনি বলতে লাগলেন," হে মাধব, হে যজ্ঞেশ্বর, হে অচ্যুত , গোবিন্দ, অনন্ত, কেশব, বিশ্বরূপ তুমি জগতের কারণ। তোমার আদি মধ্য ও অন্ত নেই। তুমিই সকল যোগীর আশ্রয়, সর্বভূতের পিতা মাতা তুমি, সৃষ্টির মূল ও জীবের পরম গতি।" তার এইপ্রকার স্তুতিতে সন্তুষ্ট হয়ে ইন্দ্রদ্যুম্নকে পরম তত্ত্বের জ্ঞান দান করলেন ভগবান। এরপর সেই ব্রাহ্মণ ইন্দ্রদ্যুম্ন জনার্দনকে প্রণাম করে জিজ্ঞেস করলেন,  তার  কর্তব্য কী আর  কর্ম‌ই বা কী? কীভাবে আরাধনা করলে মোক্ষ লাভ করা যায়? এইভাবে নিজের কর্তব্য কর্ম বিষয়ে বারবার ভগবানকে জানতে চাইলে ভগবান বিষ্ণু তখন হেসে বললেন, যে পুরুষরা বর্নাশ্রম ধর্ম পালন করে, তারা জ্ঞানযোগ, ভক্তি যোগের পথ ধরে মহাদেবের অর্চনা করবেন। এর কোন‌ও অন্যথা যেন না হয়। 

ভগবান বিষ্ণু আর‌ও বললেন যে, মোক্ষ লাভকারী ব্যক্তি এই পরম তত্ত্ব জেনে ঈশ্বরের আরাধনা করবেন। জগতকে মায়াময় মনে করে অদ্বিতীয় ভগবানের ধ্যান করবে তবেই পরমেশ্বরের সাক্ষাৎ পাবে। এরপর ভগবান তিন ভাবনার কথা বললেন, প্রথমটি হল তাঁর অর্থাৎ পরমেশ্বর সম্বন্ধে ভাবনা, দ্বিতীয়টি হল ব্যক্তি সম্বন্ধে ভাবনা আর  তৃতীয়টি হল ব্রহ্ম সম্বন্ধে ভাবনা যা সকল গুণের অতীত। জ্ঞানী ব্যক্তি যে কোন‌ও একটি ভাবনা অবলম্বন করে ধ্যান করবেন। এই  সকল বিষয়ে নিষ্ঠাবান হয়ে বিশ্বেশ্বরের উপাসনা করলেই মোক্ষ লাভ হয়। 

এরপর ইন্দ্রদ্যূম্ন জানতে চাইলেন, পরমতত্ত্ব কী? বিভূতি কী? কার্য ও কারণ কী?। এর উত্তরে ভগবান বললেন এক অবিকার্য ব্রহ্ম‌ই হল পরম তত্ত্ব। তিনি নিত্যানন্দময়, অন্ধকারের অতীত ও পরমজ্যোতি স্বরূপা। তার নিত্য বৈভবকে বিভূতি বলে। জগত তার কার্য এবং শুদ্ধ, অক্ষর, অব্যক্তই তার কারণ। তিনি সকল জীবের অন্তর্যামী, তাঁর ইচ্ছা বলে সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় হয়। যথাযথ ভাবে তত্ত্ব জেনে শাশ্বত ব্রহ্মকে সম্যকভাবে যেন ইন্দ্রদ্যুম্ন উপাসনা করেন। এভাবেই কূর্ম পুরাণে পরম তত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...