সত্যযুগে আগুনের, কলিতে পাথরের এই পাহাড় স্বয়ং শিবের প্রতিভূ

পঞ্চভূত লিঙ্গমের অন্যতম তেজ বা অগ্নি লিঙ্গ। অবস্থান নিরিখে তিনি অরুণাচলেশ্বর।

চেন্নাই থেকে ১২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত থিরুভান্নামালাই শহর। এই শহরে অরুণাচল পর্বতের পাদদেশে অরুণাচলেশ্বর মন্দির। চলতি কথায় আন্নামালাইয়ার শিবের মন্দির। পঞ্চচূড় পাহাড়ের একটি ছোট পাহাড়র নাম অরুণাচল গিরি।

e9e01838-aaea-48b3-bdb5-2c0cd8c4c9dc

অরুণাচলগিরির ধর্মীয় গুরুত্ব অসীম। কারণ অরুণাচলে পাহাড়কে স্বয়ং শিবের প্রতিভূ মনে করা হয়। এই পাহাড়ের সবকটি পাথর শিবলিঙ্গ। সব গাছ কল্প বৃক্ষ। সব জল গঙ্গাজল।

তামিল ধর্মশাস্ত্র বলে, অরুণাচল পাহাড়ের পূর্ব দিকে সূর্যদেবের আবাস। পশ্চিমে বরুণ দেবতার, দক্ষিণে বিশ্বামিত্র মুনির এবং উত্তরে আছেন শিবের ত্রিশূল এবং সিদ্ধপুরুষরুপী শিব।

ebd9270f-9f68-4e06-9314-3617c39344e9

অরুণাচলগিরি সত্যযুগে আগুনের ছিল, ত্রেতাযুগে পান্নার, দ্বাপরে সোনার এবং কলিযুগে পাথরের। পাহাড় ঘিরে কম্পাসের আট কার্ডিনাম পয়েন্টে আটটি শিব লিঙ্গের অবস্থান। লিবলিঙ্গগুলির নাম যথাক্রমে- ইন্দ্র লিঙ্গম, অগ্নি লিঙ্গম, যম লিঙ্গম, নিরুথি লিঙ্গম, বরুণ লিঙ্গম, বায়ু লিঙ্গম, কুবের লিঙ্গম ও ঈশান লিঙ্গম। এঁদের একত্রে অষ্টলিঙ্গম  এঁরা রাশি চক্রের বারোটি রাশির অধীশ্বর।

এই পাহাড়েই অগ্নিস্তম্ভ রূপে শিব আবির্ভূত হয়েছিলেন। কীভাবে আবির্ভাব ঘটেছিল তাঁর? সেই কাহিনি মেলে পুরাণ পাঠে।

একদন কৈলাসে মজার ছলে মহাদবের চোখ বন্ধ করে ধরেন পার্বতী। সঙ্গে সঙ্গে ঘন অন্ধকারে ডুবে যায় পৃথিবী। ত্রাহি রব ওঠে আলোহীন পৃথিবীতে। তখন সেই আঁধার ঘোচানোর জন্য অন্যান্য শৈব্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে মহাদেবের ধ্যানে বসেন দেবী।

তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে অরুণাচল পর্বতের চূড়ায় অগ্নিস্তম্ভ হয়ে আত্মপ্রকাশ করেন শিব। পার্বতীর সঙ্গে মিলিত হয়ে অর্ধনারীশ্বর রূপ ধারণ করেন।

আরও একটি কাহিনি শোনা যায়। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ত্রিদেবের মধ্যে কে বড় এই নিয়ে একবার তুমুল তর্ক বাঁধে। শিব তখন অগ্নিস্তম্ভ রূপ নিয়ে ব্রহ্মা এবং বিষ্ণুকে বলেন তার আদি এবং অন্তের তল খুঁজতে বলেন।

ব্রহ্মা তাঁর হাঁসে চড়ে আকাশের দিকে এবং বিষ্ণু বরাহ রূপ ধারণ করে পাতালে গেলেন, কিন্তু অনেক খুঁজেও অগ্নিস্তম্ভের শুরু-শেষ তাঁরা খুঁজে পেলেন না। এই পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে বিষ্ণু শিবের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার কর নিলেও ব্রহ্মা বললেন তিনি অগ্নিস্তম্ভের অন্ত খুঁজে পেয়েছেন। এমন মিথ্যে কথায় রেগে গিয়ে শিব শাপ দিলেন ব্রহ্মাকে পৃথিবীর কোথাও আর তাঁর পুজো হবে না। শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মা মানতে বাধ্য হন শিবের শ্রেষ্ঠত্ব, পুষ্করপ্রদেশে তাঁর পুজোর ব্যবস্থা হয়।

অরুণাচল পাহাড়ের পাদদেশে অরুণাচলেশ্বর বর্তমান মন্দিরটি নবম-দশম শতাব্দীতে চোল রাজারা নির্মাণ করেন। পরবর্তী সময়ের শাসকদের দ্বারা মন্দিরের পরিমার্জনা হয়। মূল মন্দির পূর্বমুখী। আন্না মালাইয়ার বা অরুণাচলেশ্বর পঞ্চভূতলিঙ্গের তেজলিঙ্গ। অপর নামে অগ্নি লিঙ্গ।

এই লিঙ্গদেবকে নিয়ে নানা মত প্রচলিত আছে। কেউ বলেন শিবলিঙ্গটি গরম এবং সেই জন্য এই গর্ভগৃহের তাপমাত্রা বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে বেশি। কেউ কেউ এই লিঙ্গকে Tesla Coil- এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। তবে এ সবই বিতর্কিত বিষয়।

শিবের অগ্নিস্তম্ভরূপে অরুণাচল পর্বতের চূড়ায় আবির্ভূত হওয়ার ঘটনাকে উপলক্ষ করে প্রতিবছর তামিল কার্তিক মাসে ১০ দিন ধরে চলে উৎসব। উৎসবকে স্থানীয় ভাষায় ‘কীর্তিগাই দীপম’ বলা হয়। প্রথম দিন সকালে মন্দিরে ধ্বজা উত্তোলনের পর আন্নামালাইয়ার উৎসব মূর্তি এবং পঞ্চমূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা করা হয়। কার্তিক পূর্ণিমায় এই উৎসবের শেষ দিন। সেই দিন অরুণাচল পর্বতের চূড়ায় একটি বিশাল প্রদীপ ‘মহাদীপম’ স্থাপন করা হয়। ৩ হাজার কেজি ঘি দিয়ে পূর্ণ করা হয় প্রদীপ। সূর্যাস্ত ও চন্দ্রোদয়ের মাহেন্দ্রক্ষণে শিখা জ্বালানো হয় প্রদীপের।

‘কীর্তিগাই দীপম’ উৎসব উপলক্ষ্যে বহু ভক্তের সমাগম হয়। অরুণাচল গিরি পর্বত প্রদক্ষিণে অংশ নেন তাঁরা।  

  • ট্যাগ

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...