সতীপীঠঃ কাশ্মীরে স্বামী বিবেকানন্দ সাক্ষাৎ অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন মা ক্ষীরভবানী

কাশ্মীরের ক্ষীরভবানী মন্দির। শ্রীনগর থেকে পূর্ব দিকে চোদ্দ মাইল দূরে তুলমূল গ্রামে এই মন্দির অবস্থিত। কথিত আছে যে, এই মন্দির একান্নপীঠের অন্যতম এক পীঠ। ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে এখানে দেবী সতীর কণ্ঠদেশ পতিত হয়েছিল। যে তন্ত্রগ্রন্থগুলির সাহায্যে একান্নপীঠের অবস্থান নির্ণীত হয়, সেখানে কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই যে, দেবী সতীর কণ্ঠদেশ ঠিক কোথায় পতিত হয়েছিল। সেখানে শুধু বলা হয়েছে ‘কাশ্মীর’-এর নাম। এই যেমন ‘পীঠনির্ণয়’ তন্ত্রগ্রন্থে একটি শ্লোকে বলা হয়েছে যে—

‘কাশ্মীরে কণ্ঠদেশশ্চ ত্রিসন্ধ্যেশ্বর ভৈরবঃ।

মহামায়া ভগবতী গুণাতীত বরপ্রদা।।’

শ্লোকটির অর্থঃ কাশ্মীরে দেবী সতীর কণ্ঠ পতিত হয়েছিল। তার ফলে সেখানে যে পীঠ গড়ে উঠেছে, সেই পীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ‘মহামায়া’ নামে প্রসিদ্ধা; আর তাঁর ভৈরব মহাদেব ‘ত্রিসন্ধ্যেশ্বর’ নামে প্রসিদ্ধ।

এবার মুশকিল হচ্ছে, কাশ্মীর তো কোন ক্ষুদ্র গ্রাম বা স্থাননাম নয়; সেখানে ঠিক কোথায় দেবী সতীর অঙ্গ পতিত হয়েছিল তা নিশ্চিত করে এবার নির্ণয় করবে কে! এখান থেকেই ভক্তজনের বিশ্বাসের ওপর ভর করে তিনটি পীঠের কথা উঠে আসে কণ্ঠদেশ পতনের স্থান হিসেবে। এই তিনটি পীঠ হল, ‘অমরনাথ’, ‘ক্ষীরভবানী’ ও ‘শারদাপীঠ’। শারদাপীঠের কথা আগেই একদিন বলেছি, আজ বলছি ক্ষীরভবানীর কথা।

তন্ত্রগ্রন্থে দেবীর নাম ‘মহামায়া’ কথিত হলেও দেবী এখানে ভিন্ন ভিন্ন অনেকগুলি নামে পরিকীর্তিতা। সেই নামগুলি হল, ‘মহারাজ্ঞী দেবী’, ‘রাগন্যা দেবী’, ‘রজনীদেবী’, ‘রাগন্যা ভগবতী’ প্রভৃতি। তবে দেবী আপামর সকলের কাছে ‘ক্ষীরভবানী’ নামেই প্রসিদ্ধা। আমরা জানি যে, ‘ভবানী’ হলেন দেবী দুর্গা। কিন্তু এখানে তাঁর ‘ভবানী’ নামের সঙ্গে ‘ক্ষীর’ কথাটি যুক্ত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন যুক্ত হয়েছে?

আসলে, সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভক্তগণ দেবীকে ক্ষীর নৈবেদ্য নিবেদন করে পুজো করেন বলেই, দেবীর নাম ‘ক্ষীরভবানী’ হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু দেবীকে নৈবেদ্য হিসেবে ক্ষীর নিবেদনের প্রথা কবে থেকে শুরু হল? এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে দুটি কিংবদন্তির পরিচয় পাওয়া যায়। যথাঃ

এক, কাশ্মীরের তুলমূল গ্রামটিতে কাশ্মীরী হিন্দুদের বাস। ক্ষীরভবানী তাঁদের কুলদেবী। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, এই দেবী সুপ্রাচীনকাল থেকে তাঁদের রক্ষা করে আসছেন। প্রাচীন কালে কোন এক সময় দেবী স্বয়ং এক কন্যার রূপ ধারণ করে তাঁদেরই কোন-একজনের কাছে ক্ষীর খেতে চেয়েছিলেন। তখন তিনি গরুর দুধ দিয়ে উত্তম ক্ষীর প্রস্তুত করে দেবীর ইচ্ছেপূরণ করেছিলেন। এখান থেকেই দেবীর নিত্যদিনের পুজোয় নৈবেদ্য হিসেবে ক্ষীর নিবেদনের প্রথা শুরু হয়। এবং দেবী ‘ক্ষীরভবানী’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

দুই, দেবী পৌরাণিক যুগে রাবণের লঙ্কারাজ্যে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেখানে নিত্যদিন রাবণরাজা তাঁকে ক্ষীর নিবেদন করে পুজো করতেন। এবং তিনিই দেবীকে ‘ক্ষীরভবানী’ নামে অভিহিত করেন।

এবার প্রশ্ন ওঠে যে, দেবী যদি লঙ্কারাজ্যেই অধিষ্ঠিত ছিলেন, তাহলে সেখান থেকে সুদূর কাশ্মীরে এলেন কীভাবে? এখন এই প্রশ্নের উত্তরে যা বলব, তাও আসলে কিংবদন্তি। সেটি হলঃ

লঙ্কারাজ্যে দেবী অপূর্ব এক সোনার মূর্তিরূপে অধিষ্ঠিত ছিলেন। রাবণরাজের ভক্তিবিনম্র আন্তরিক উপাসনায় অত্যন্ত তুষ্টও ছিলেন। কিন্তু রাবণ যখন সীতাদেবীকে হরণ করে পরস্ত্রী হরণের অমার্জনীয় পাপ করলেন, তখন থেকেই দেবী বিমুখ হলেন তাঁর প্রতি। তারপর শ্রীরামচন্দ্র বানরসেনা নিয়ে সেতুনির্মাণ করে একদা লঙ্কারাজ্যে প্রবেশ করলেন। শুরু হল রাম-রাবণের যুদ্ধ। দেবী রাবণের উপর অপ্রসন্ন হয়ে আগেই রাজ্য ছাড়তে চেয়েছিলেন, এবার শ্রীরামের লঙ্কাজয়ের জন্য দেবীর লঙ্কাত্যাগ জরুরি হয়ে উঠল। কেননা, দেবী যতদিন রাজ্যে অধিষ্ঠিত থাকবেন, ততদিন লঙ্কা কেউ জয় করতে পারবেন না—এমনই বর দেবীর কাছ থেকে আদায় করেছিলেন রাবণ। ফলে লঙ্কায় ন্যায় ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে দেবীর লঙ্কাত্যাগ অনিবার্য হয়ে উঠল। দেবী মহাবীর হনুমানকে ডেকে বললেন সে-কথা। বললেন, পাপের পুরী লঙ্কার বাইরে তাঁকে কোন পবিত্র স্থানে রেখে আসতে।

দেবীর অনুরোধে হনুমান প্রস্তুত হতেই দেবী রাবণ-নির্মিত সোনার মূর্তি ত্যাগ করে একটি পাথরের পিণ্ডে অধিষ্ঠিত হলেন। হনুমান সেই পাথরের পিণ্ড মাথায় নিয়ে পবিত্রস্থানের খোঁজে আকাশপথে উপস্থিত হলেন হিমালয়ের কাশ্মীরপ্রদেশে। এই অঞ্চলে সেই সময় রাবণরাজার পিতা ঋষি পুলস্ত্যর তপস্যাক্ষেত্র ছিল। তাঁর তপস্যার প্রভাবে এই স্থান পবিত্র হয়ে উঠেছিল। তাছাড়া এই অঞ্চলের ‘তুলমূল’ নামক স্থানেই পতিত হয়েছিল দেবী সতীর কণ্ঠদেশ। গড়ে উঠেছিল গুপ্তপীঠ। সুরম্য প্রস্তরমালা ও অপূর্ব চিনার গাছের ছায়াঘেরা এই পীঠস্থানে উদ্ভূত হয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল একটি পবিত্র ঝর্ণা। মহাবীর হনুমান এই পীঠের পবিত্রতা ও মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে এখানেই স্থাপন করলেন আপন মস্তকের সেই দৈবী প্রস্তরপিণ্ড। তারপর থেকে দেবী এভাবে এখানেই অধিষ্ঠিত হয়ে রইলেন।

রামায়ণের যুগ পেরিয়ে কেটে গেল এরপর বহু বহু কাল। ক্রমে ক্রমে তুলমূলে গড়ে উঠল ছোট্ট বসতি। ব্রাহ্মণদের গ্রাম। দেবী এবার আত্মপ্রকাশের তাগিদ অনুভব করলেন। একদিন সর্পরূপে কৃষ্ণপণ্ডিত তপলু নামের এক ব্রাহ্মণপণ্ডিতের সামনে হাজির হলেন। তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন পীঠস্থানে। বুঝিয়ে দিলেন আপন উপস্থিতি। তারপর ধীরে ধীরে দেবীর পীঠ সাধারণের কাছে পরিচিতি পেল, নিত্যপুজোর অবকাশ ঘটল, পীঠস্থানের পবিত্রকুণ্ড আবিষ্কৃত হল, দেবী হয়ে উঠলেন তুলমূলের ব্রাহ্মণদের কুলদেবী। এই সময় দেবী কন্যার রূপ ধরে রাবণের নিবেদিত ক্ষীর ব্রাহ্মণদের কাছে খেতে চেয়ে নৈবেদ্য হিসেবে ক্ষীর নিবেদনের প্রথা তৈরি করে হয়ে উঠলেন সকলের আরাধ্যা দেবী ‘ক্ষীরভবানী’।

দেবীর কোন মন্দির ছিল না। গত শতকের দ্বিতীয় দশকে এখানকার মহারাজা প্রতাপ সিংহ শ্বেতপাথরের বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করিয়ে দেন। দেবী সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই পাথর-পিণ্ডের প্রতীকেই পূজিতা হতেন। এই রাজা প্রতাপ সিংহই প্রথম দেবীর একটি ছোট্ট কালো পাথরের মূর্তি নির্মাণ করিয়ে মন্দিরে পাথরের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করেন। দেবীর মূর্তি প্রকাশ্য নন, সর্বদা কাপড়ে আবৃত থাকেন। মূর্তিটি ভবানী-দুর্গার মূর্তি। দেবীর নিকটেই রয়েছেন ভৈরব শিব, শ্বেতপাথরে নির্মিত হয়েছে তাঁর সেই লিঙ্গমূর্তি। এও রাজা প্রতাপ সিংহের কীর্তি।

মন্দিরটি খুবই ছোট। পবিত্র ঝর্ণার ওপরেই তা নির্মিত হয়েছে। ঝর্ণাটিকে শ্বেতপাথরের দেওয়াল দিয়ে চতুষ্কোণ কুণ্ডের আকারে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই কুণ্ডকে বলা হয়, ‘রাগন্যা কুণ্ড’। দেবীকে উৎসর্গ করা ক্ষীর পূজারি ও ভক্তজন এই কুণ্ডেই নিবেদন করেন। সাধারণের কাছে এই কুণ্ড পরম আশ্চর্যের বস্তু। কেননা, এই কুণ্ডের জল সময়ে সময়ে ভিন ভিন্ন রঙের হয়ে ওঠে। কখনও তা লাল, কখনও সবুজ, কখনও বা নীল, কখনও বা গোলাপি হয়ে ওঠে। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সেটেলমেন্ট কমিশনার ওয়াল্টার লরেন্স এই অঞ্চলে জরিপের কাজ করতে এসে এই ঝর্ণা দেখে অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হন। তখন এই ঝর্ণার জলের রঙ ছিল গোলাপি। তিনি তাঁর বিবরণে এ-কথাটি লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তুলমূলের ব্রাহ্মণরা মনে করেন যে, এই কুণ্ডের জল যদি কালো রঙের হয়ে ওঠে, তাহলে বুঝতে হবে, অশুভ কিছু ঘটবে!

দেবীর কথা ও দেবস্থান তুলমূলের মাহাত্ম্যকথা কলহনের ‘রাজতরঙ্গিণী’ গ্রন্থে এবং আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থাবলীতে উল্লিখিত আছে। স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ ক্ষীরভবানীর মাহাত্ম্য শ্রবণ করে দেবীর মন্দিরে আসেন। তারপর এখানে ছ’দিন অবস্থান করে, দেবীকে ক্ষীর নিবেদনের মাধ্যমে পুজো করে, নিত্যদিন কুমারী পুজোর মধ্য দিয়ে দেবীর উপাসনা করে এবং তপস্যায় অবশিষ্ট কালযাপন করে দেবীর সাক্ষাৎ অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন। সে-কথা মাথায় রেখে  বিশেষ পুজো, বিশেষ পার্বণ উপলক্ষে দেবীর অনুগ্রহ লাভ করতে বছরের বিভিন্ন সময়ে সারা ভারতের অসংখ্য ভক্তজন এই মন্দিরে ছুটে আসেন।।...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...