শরৎচন্দ্রের শেষের দিন যাপন

বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় উপন্যাস আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আজ কার্যত সমর্থক। কিংবদন্তি কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখাই সম্ভবত সারা ভারতে সবথেকে বেশি পঠিত, অনূদিত এবং সিনেমা-নাটকে রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যই শরৎবাবুকে রাজা বানিয়েছিল। ১৮৭৬ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামের এক গরীব ব্রাহ্মণ পরিবারে শরৎচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল।

শরৎচন্দ্রের বাবা মতিলাল চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল উত্তর ২৪ পরগণা জেলার মামুদপুরে৷ দেবানন্দপুরের প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালায় পাঁচ বছর বয়সে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। দু-তিন বছর পরে মামা দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে ছিলেন। ১৮৮৭ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভাগলপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। বিহারের ভাগলপুরে মামাবাড়িতেই কাটিয়েছিলেন শৈশবের বেশির ভাগ সময়।  

১৮৮৯ সালে মতিলাল চট্টোপাধ্যায়ের ডিহিরির চাকুরি চলে যায়, ফলে পরিবারসহ দেবানন্দপুরে চলে গেলে শরৎচন্দ্র। স্কুল ছাড়তে হয় তাঁকে, এরপর হুগলি ব্রাঞ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে ১৮৯২ সালে হুগলি ব্রাঞ্চ বিদ্যালয়ে ফি দিতে না কারণে, শরৎবাবুকে সেই বিদ্যালয়ও ছাড়তে হয়।

সেই সময়ে তিনি কাশীনাথব্রহ্মদৈত্য নামে ২টি অসাধারণ গল্প লিখে ফেলেছেন তিনি। ১৮৯৩ সালে পিতা মতিলাল আবারও ভাগলপুর ফিরে যান, তখন তাদের সেই সময়ের প্রতিবেশী সাহিত্যিক তথা তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রেকে তার বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। শরৎচন্দ্র ঐ বিদ্যালয় থেকে ১৮৯৪ সালে এনট্রান্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে পাস করে তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। শরৎচন্দ্র তখন ছাত্র পড়িয়ে নিজের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জন করে যান। তারপরও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পারায়, পরীক্ষায় বসতে পারেন না। ১৯০৫ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পচাত্তর টাকা বেতনে বার্মা রেলের হিসাব পরীক্ষকের চাকরিতে যুক্ত হন।

রেঙ্গুনে কলকারখানার মিস্ত্রিদের পল্লিতে তিনি বসবাস করতেন। শরৎচন্দ্রের বাড়ির নীচে এক ঘর ব্রাহ্মণ পরিবার থাকত, সেই ব্রাহ্মণের কন্যার নাম ছিল শান্তি দেবী। শান্তি দেবীর পিতা, এক মদ্যপের সঙ্গে তার বিয়ে দেন, মদ্যপের হাত থেকে রেহাই পেতে শান্তি দেবী শরৎচন্দ্রকে অনুরোধ জানালে, শরৎচন্দ্র তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হন। পরে তাদের এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে, দূর্ভাগ্য বসত রেঙ্গুনেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী ও তাদের এক মাত্র সন্তানের মৃত্যু হয়। বহুকাল পর শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনের কৃষ্ণদাস অধিকারীর অনুরোধে তার ১৪ বছরের কন্যা মোক্ষদার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহের পরেই মোক্ষদার নাম পরিবর্তন করে, তিনি তাঁর স্ত্রীয়ের নাম হিরন্ময়ী রাখেন।

 

saratchandra1

 

সাধারণ জীবন ছিল শরৎবাবুর, তদানিন্তন সময়ে তাঁর সমসাময়িক দীনবন্ধু মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখেরা ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জমিদার। শরৎচন্দ্র সেখানে সাধারণ পরিবারের সাধারণ জীবন যাপন করা এক মানুষ। এক এবং একমাত্র সাহিত্যেরই জোরেই দুপায়ে ভর দিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পেরেছিলেন শরৎবাবু। পেয়েছিলেন গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা।

সেই প্রসঙ্গে, অজিতকুমার ঘোষের মতে, "শরৎচন্দ্র সোজাভাবে, স্পষ্ট ভাষায় ও দুঃখ বেদনার কারুণ্যে সিক্ত করিয়া সমাজের সমস্যা তুলিয়া ধরিলেন এবং আমাদের প্রচলিত সংস্কার, নীতিবোধ ও ধর্মবোধের অন্যায় ও জবরদস্তি চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া দিলেন। ইহার ফলে আমাদের বদ্ধ অচলায়তনের দ্বার যেন হঠাৎ খুলিয়া গেল, এবং সেই মুক্ত দ্বার দিয়া যত আলো ও বাতাস আসিয়া মুক্তির আনন্দে আমাদিগকে চঞ্চল করিয়া তুলিল।"

সরলা দেবী তখন ভারতীর সম্পাদক এবং সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় কলকাতা থেকে তাঁর নামে কাগজ চালান।সৌরীন্দ্রমোহন জানতেন, রেঙ্গুন যাওয়ার আগে নিজের লেখাগুলি সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে রেখে গিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। সেখান থেকে ছোট উপন্যাস 'বড়দিদি' আনিয়ে তিন কিস্তিতে ভারতীতে ছাপিয়েও দেন তিনি। লেখকের অনুমতি নেননি, কারণ নেওয়ার চেষ্টা করলে মিলত না। সেই লেখা পাঠকমহলে সমাদৃত হয়, লেখা নিয়ে রীতিমতো হইচই পড়ে যায়। অজ্ঞাতেই পাঠক ও সমালোচক মহলে শরৎচন্দ্রের লেখা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হতে শুরু হয়।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কালের নিয়মে হারিয়ে যান লেখক শরৎচন্দ্র। প্রায় ১৮ বছর পরে, ১৯১৩ সালে শরৎচন্দ্র প্রত্যাবর্তন করেন। বাংলা সাহিত্যে শরতের পুনরাগমন হয়। যমুনা পত্রিকাতে লেখা ছাপা হতে শুরু করে। শুধু ফেরা নয়, অবিশ্বাস্য দ্রুততায় পাঠকমহলে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। কয়েক বছরের মধ্যে চাকরি ছেড়ে পাকাপাকি সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র। চরিত্রহীন বই আকারে বেরোল, দাম সাড়ে তিন টাকা। প্রথম দিনই সাড়ে চারশো কপি বিক্রি হয়েছিল।

বাংলা সাহিত্যে এই রেকর্ড আর কারও ছিল না। পরে শরৎবাবু নিজেই নিজের রেকর্ড ভাঙেন, শরৎচন্দ্রের পথের দাবী ফের দ্রুত হারে বিকোতে শুরু করে। আদপে রেঙ্গুনে অজ্ঞাতবাসের জন্য গিয়ে, সেখােনই আত্মপ্রকাশ করেন সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

নিজের সাহিত্য জীবন সম্পর্কে শরৎবাবু বলে গিয়েছেন, 'একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ যখন সাহিত্য সেবার ডাক এলো, তখন যৌবনের দাবী শেষ ক'রে প্রৌঢ়ত্বের এলাকায় পা দিয়েছি। দেহ শ্রান্ত, উদ্যম সীমাবদ্ধ- শেখবার বয়স পার হয়ে গেছে। থাকি প্রবাসে, সব থেকে বিচ্ছিন্ন, সকলের কাছে অপরিচিত, কিন্তু আহ্বানে সাড়া দিলাম, ভয়ের কথা মনেই হোলোনা।'

রামের সুমতি, পথনির্দ্দেশ, বিন্দুর ছেলে, নারীর মূল্য, চরিত্রহীন একে একে জন্ম নিল। যমুনা থেকে ভারতবর্ষ পত্রিকা আসতে আসতে সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের পরিসর বাড়তে লাগলো। কলম চালিয়ে অর্থলাভ হতে লাগল। কেবল ভারতবর্ষ নয়, শরৎচন্দ্র ছড়িয়ে পড়লেন বঙ্গবাণী, নারায়ণ, বিচিত্রায়। কোনও কোনও উপন্যাস সরাসরি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল, যেমন বামুনের মেয়ে। লিখলেন বিরাজ-বৌ, পণ্ডিত-মশাই, বৈকুণ্ঠের উইল, মেজদিদি, দত্তা, পল্লীসমাজ, অরক্ষণীয়া, নিষ্কৃতি, গৃহদাহ, দেনা-পাওনা, নববিধান, মহেশ, পথের দাবী, শেষ প্রশ্ন... এত স্বল্প সময়ের মধ্যে পরপর এতগুলি জনপ্রিয় ও অমর সৃষ্টি বোধহয় শরৎচন্দ্রই সৃষ্টি করতে পারেন। সত্যিই বিস্ময়!

নারায়ণ পত্রিকার গল্পের জন্য শরৎচন্দ্রকে একটা সই করা চেক পাঠিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, সঙ্গে লিখেছিলেন, 'আপনার মতন শিল্পীর অমূল্য লেখার মূল্য স্থির করবার স্পর্দ্ধা আমার নেই, টাকার ঘর শূন্য রেখে চেক পাঠালুম, এতে নিজের খুসি-মত অঙ্ক বসিয়ে নিতে পারেন!' নিজের মূল্যও নির্ধারণ করেছিলেন শরৎচন্দ্র একশো টাকা! দেশবন্ধুর এই ঘটনাই সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তার অনুমান করা।

বাংলা নাট্যকারদের মধ্যেও শরৎ-সাহিত্যের চাহিদা তৈরি হয়েছিল। সর্বাগ্রে অভিনীত স্টার থিয়েটারে বিরাজ-বৌ হয়েছিল। নাট্যরূপ দিয়েছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর শিশিরকুমার ভাদুড়ীও শরৎ-সাহিত্যের নাট্যরূপ দেন। ভারতীতে দেনা-পাওনার নাট্যরূপ দিয়েছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী, নাম ষোড়শী। অভিনয় করালেন শিশিরকুমার। সাফল্যের পরে অভিনীত হল রমা, চরিত্রহীন, অচলা, বিজয়া। নাটকের পরে চলচ্চিত্রের রুপোলি পর্দায় উঠে এল শরৎ-সাহিত্য। নির্মিত হল আঁধারে আলোর চিত্ররূপ। তার পরে দেবদাস, শ্রীকান্ত, বিজয়া, পণ্ডিত মশাই ইত্যাদি। তাঁর লেখা দেশি-বিদেশি ভাষায় অনূদিত হতে থাকল। এক কথায়, সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের উত্তরণ ও উত্থান রূপকথার মতো।

হেমেন্দ্রকুমার রায় বলেছিলেন, 'যৌবনে যে শরৎচন্দ্রের দেশে মাথা রাখবার ছোট্ট একটুখানি ঠাঁই জোটেনি, ট্যাঁকে দুটি টাকা সম্বল করে যিনি মরিয়া হয়ে মগের মুল্লুকে গিয়ে পড়েছিলেন, প্রৌঢ় বয়সে তিনিই যে দেশে ফিরে এসে বালিগঞ্জে সুন্দর বাড়ী, রূপনারায়ণের তটে চমৎকার পল্লী-আবাস তৈরি করবেন, মোটরে চড়ে কলকাতার পথে বেড়াতে বেরুবেন...'সত্যিই, তাঁর দূর বা নিকটজনেরা ভাবতেও পারেননি।'

এবার দেশে ফেরার পালা, কর্মসূত্রে ব্রহ্মদেশ যেতে হয়েছিল তাঁকে। ১১ বছর পর রেঙ্গুন থেকে ফিরেই হাওড়া জেলার শিবপুরে বাড়ি ভাড়া নিলেন। ভিড় আর ভাল লাগছিল না শরৎচন্দ্রের। চাই অপার নিস্তব্ধতা। তাই পাণিত্রাসে সামতাবেড়ে নিরালাবাস বানালেন। আজও দেউলটি লাগোয়া সামতায় 'শরৎ কুঠি' দেখা যায়। ১৯১৯ সালে এখানে জমি কেনার পর শরৎচন্দ্র নিজে গ্রামের নাম বদলে সামতাবেড় রাখেন। বাগানঘেরা দোতলা বাড়ি, লেখার ঘরের জানলা দিয়ে রূপনারায়ণ দেখা যেত।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির সামনে দিয়েই আজও বয়ে চলেছে রূপনারায়ণ, তাঁর জীবনকালে নদী আরও অনেক চওড়া ছিল, বয়ে যেত বাড়ির সামনে দিয়েই। লেখক তাঁর নিজের ঘরে বসে জানলা দিয়েই দেখতে পেতেন নদীর বয়ে চলা, নৌকার আসা যাওয়া। এখন নদী পিছিয়ে গিয়েছে অনেকটাই, সেই বিস্তৃতিও আর নেই। এখানেই তিনি লিখতেন, পড়তেন, ভাবতেন। বাগানে গাছেদের সেবা করতেন, পুকুরে মাছেদের খেতে দিতেন।

জানা যায়, সামাতাবেড়ে নতুন বাড়ি তৈরি করতে ১৭ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছিল। ১৯২৩-এর ফেব্রুয়ারি থেকে শরৎচন্দ্র এখানে থাকা শুরু করেন। দেবদাস, বৈকুণ্ঠের উইল, দেনাপাওনা, দত্তা, শ্রীকান্ত, পরিণীতা, নিষ্কৃতির মতো জনপ্রিয় উপন্যাস এবং মহেশ, রামের সুমতির মতো বিখ্যাত ছোটোগল্প এখানে বসেই লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র। বাড়িতে আপনি দেখতে পাবেন বার্মা কাঠের আসবাব, শরৎচন্দ্রের ব্যবহৃত লেখার ডেস্ক, হুঁকো, জাপানি ঘড়ি এবং বইয়ের শেলফ। সব কিছুই যত্ন করে সাজানো। সামতাবেড়ের দোতলা বাড়িটি ব্রহ্মদেশীয় স্থাপত্যশৈলী অনুসরণ করে বানানো।

এখানে শরৎচন্দ্র তাঁর জীবনের ১২টি বছর কাটিয়েছেন। দোতলা বাড়িতেই সাহিত্যিকের নিজস্ব ব্যবহৃত সামগ্রী সংরক্ষণ করে রাখা আছে। একটি ছোটো গ্রন্থাগারও আছে। ১৯৭৮-এর বন্যায় বাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সঠিক পুনর্নিমাণের কাজ শুরু হয় ২০০৯ সালে। আবার পূর্বের অবস্থায় বাড়িটিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ২০০১ সাল থেকে বাড়িটি হেরিটেজ তকমা পেয়েছে।

এই বাড়িতেই থাকতেন শরৎচন্দ্রের দ্বিতীয় স্ত্রী হিরণ্ময়ী দেবী এবং ভাই স্বামী বেদানন্দ, যিনি পরে বেলুড় মঠের সন্ন্যাসী হন। বাগানে হিরণ্ময়ী দেবীর সমাধি দেখতে পাবেন। বাড়িতে বাগান চর্চা করতেন শরৎচন্দ্র, তাঁর নিজের হাতে রোপণ করা বাঁশ এবং পেয়ারা গাছ রয়েছে বাড়ির বাগানে।

শরৎচন্দ্রের বাড়ির বাড়তি আকর্ষণ শ্রীরাধা এবং মদনগোপালের মন্দির। মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ দেখার মতো। একটি প্রাচীন আটচালার মন্দির আছে শ্রীরাধা ও মদনগোপালের। মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কারুকার্য দেখার মতো। ১৬৫১ সালে মঙ্গলাহাটের জমিদার মুকুন্দপ্রসাদ রায়চৌধুরি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই দেউলের নামেই বোধ হয় এই জায়গার নামকরণ। শান্ত নিরিবিলি এই গ্রামে প্রকৃতির মাঝে বসেই শরৎচন্দ্র তাঁর অনেকগুলি কালজয়ী গল্প-উপন্যাস রচনা করেছিলেন।

তাঁর বহুল জনপ্রিয় ও বিখ্যাত গল্প রামের সুমতি শরৎচন্দ্র এই বাড়িতে বসেই লিখেছিলেন। যারা রামের সুমতি পড়েছে, তাদের সবার লেখকের বাড়ির সামনের পুকুরটা দেখেই কার্তিক, গণেশের কথা মনে পড়বেই। লেখককের ঠাকুরঘরে চিত্তরঞ্জন দাশের উপহার দেওয়া রাধাকৃষ্ণের মূর্তি রয়েছে। রাধাকৃষ্ণ এখনও প্রত্যেকদিন নিত্য পূজিত হন। দেশবন্ধু, নেতাজিসহ এই বাড়িতেই অনেক গুণি মানুষের পায়ের ধুলো পড়েছে।

এ বাড়িতেই তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে মিটিং করতেন। শরৎচন্দ্রের আবাসগৃহে প্রবেশপথে, ফটকে সোনালি অক্ষরে লেখা, "সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছু, যারা বঞ্চিত, যারা দুর্বল, উৎপীড়িত, মানুষ হয়েও মানুষে যাদের চোখের জলের কখনও হিসাব নিলে না, নিরুপায় দুঃখময় জীবনে যারা কোনদিন ভেবেই পেলে না সমস্ত থেকেও কেন তাদের কিছুতেই অধিকার নেই,-এদের কাছেও কি ঋণ আমার কম? এদের বেদনাই দিলে আমার মুখ খুলে, এরাই পাঠালে আমাকে মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে"। ফটক পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকলেই চোখে পড়বে শরৎচন্দ্রের এক আবক্ষ মর্মর মূর্তি।

ভাবতে অবাক লাগে, যে মানুষটির জন্য দেউলটি এবং সামতাবেড়ের এত খ্যাতি, তিনি এখানে থাকতে এসে প্রথমে বাধার সম্মুখীন হন। ভারতীয় সমাজের কুপ্রথাগুলি নিয়ে সরব ছিলেন শরৎচন্দ্র। যেমন নারী নিপীড়ন কিংবা জাতিভেদ প্রথা। তাই গ্রাম্য প্রবীণেরা প্রথমে তাঁকে গ্রহণ করতে চাননি। তাঁকে নানানভাবে উত্যক্ত করতেন। যদিও পরে সবার মন জিতে নেন শরৎচন্দ্র।

তাঁর পরোপকারী কাজকর্ম গ্রামবাসীদের আকর্ষণ করে। গ্রামবাসীদের চিকিৎসার জন্য একটি হোমিওপ্যাথি চেম্বার গড়ে তুলেছিলেন, সেখানে রোগীদের বিনাপয়সায় ওষুধ দিতেন শরৎচন্দ্র। যা এখনও রয়েছে। ১৯২৩ সাল থেকে ১২ বছর তিনি দেউলটি লাগোয়া অঞ্চলে ছিলেন। শেষ উপন্যাস বিপ্রদাস এখানে বসেই লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র। তারপর কলকাতায় চলে আসেন।

৩ বছর পরে তিনি মারা যান। তবে ১৯৩৫-৩৮ বছর পর্যন্ত তিনি নিয়মিত এখানে আসতেন। তাঁর​ জীবনে জরা আসে, রোগব্যাধি বাসা বাঁধে। শরৎচন্দ্রের অসুখ ছিলই। ১৯৩৭ সালের সময়টায় শরৎচন্দ্র প্রায়শই অসুস্থতার মধ্যে থাকতেন। এই সময়ে প্রত্যেক দিনই জ্বর আর শরীরময় যন্ত্রণা হতে থাকল তাঁর শরীরে। চিকিৎসকদের পরামর্শক্রমে তিনি স্বাস্থ্যের উন্নতি উদ্দেশ্যে দেওঘর যাত্রা করলেন। ৩-৪ মাস অতিক্রান্ত করে কলকাতা ফিরে এলেন, আবার অসুস্থতা শুরু হল।

তখন তার যকৃতের ক্যান্সার ধরা পড়ে, যা তার পাকস্থলী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। বিধানচন্দ্র ও কুমুদশঙ্কর রায় প্রমুখ চিকিৎসকরা তাঁকে অস্ত্রোপচার করতে বলেন। চিকিৎসার জন্যে তাঁকে দক্ষিণ কলকাতার সাবার্বান হসপিটাল রোডের একটি ইউরোপীয় নার্সিং হোমে এবং পরে ৪ নম্বর ভিক্টোরিয়া টেরাসে অবস্থিত পার্ক নার্সিং হোমে ভর্তি রাখা হয়।

১৯৩৮ সালে ১২ জানুয়ারি শল্য চিকিৎসক ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অস্ত্রোপচার করেন, কিন্তু শেষরক্ষা আর হয়নি। চার দিন পর বাংলার ১৩৪৪ সনের ২রা মাঘ, ১৬ জানুয়ারি সকাল দশটায় ৬১ বছর বয়সে শরৎচন্দ্র শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন পরলোক গমন করেন। বিরাট শোভাযাত্রায় কেওড়াতলা মহাশ্মশানে সাহিত্যিকের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল। জীবনের শেষ এক-দেড় দশক প্রকৃতির সান্নিধ্যে নৈশব্দের যাপনে অতিবাহিত করেছিলেন তিনি। মেতে ছিলেন সৃষ্টিতে, সেই সৃষ্টিই তাঁকে অমর করে গেল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...