সঞ্জীবের সন্ন্যাস থেকে সাহিত্য

তিনি একদিকে বিজ্ঞানের ছাত্র, অন্যদিকে আধ্যাত্মিকতার প্রতি প্রবল আসক্ত। অথচ এই বৈপরীত্যের মাঝেই তিনি সার্থক রসস্রষ্টা ও সফল জীবন-দার্শনিক। 'তিনি' সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। আধ্যাত্মিকতা তাঁর রক্তে। তাই তাকে অস্বীকার করার ইচ্ছে বা উপায় কোনটাই তাঁর ছিল না। পিতামহ ছিলেন ঘোর শাক্ত। তন্ত্র-উপাসক। পিতার জীবনও ছিল গৃহী-সন্ন্যাসীর মতো। শৈশবে মা মারা গেলেন। ফলে, তিনি বড় হলেন অধ্যাত্মবাদী দুই পুরুষের সাহচর্যে। স্বভাবতই চেতনে-অবচেতনে অধ্যাত্মভাবনা বাসা বাঁধল।

বরানগরের কুঠিঘাটে বাড়ির কাছাকাছি ভিক্টোরিয়া স্কুল। সেই স্কুলের দেওয়াল পত্রিকার নাম, 'ভবিষ্যতে আমরা'। তা, সেই পত্রিকায় বালক সঞ্জীবের উপর ভার পড়ল গান্ধীজির জীবনী লেখার। লিখতে গিয়ে পড়তে হল। গান্ধীজির জীবনী। গান্ধীজির আত্মজীবনী। পরিচয় হল এক প্রায়-সন্ত জীবনের সঙ্গে। নেশা ধরল। সাধক-সন্তদের জীবনী পড়তে শুরু হল। মনে হল, সন্ন্যাসী হতে হবে, সাধু হতে হবে, ঈশ্বরের সন্ধানে বেরুতে হবে। নিজেকে তৈরি করতে হবে। করলেন।

পাশ-টাস করে সঞ্জীব রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী হবেন ঠিক করেই ফেলেছেন। বাবার অনুমতি নেওয়াটুকু শুধু বাকি। সঞ্জীব তখন মিশনেরই স্কুলের শিক্ষক। রয়েছেন দেওঘরে। সেখানেই একদিন বাবা সহসা হাজির হয়ে বুঝিয়ে দিলেন যে, জগৎপিতা আর জন্মদাতা পিতার মধ্যে কোন ভেদ নেই। পিতৃসেবার মধ্যেই রয়েছে ঈশ্বর সেবার ঔদার্য। গুরুও বললেন একই কথা। কাজেই, সঞ্জীব সংসার ছাড়তে চাইলেও, সংসার তাঁকে ছাড়ল না। ফিরলেন কলকাতায়। নিলেন ক্যালকাটা কেমিকেলসে কেমিস্টের চাকরি। এই রকম অবস্থায় বাল্যের খেলার সাথি, প্রেমিকা হয়ে ফিরে এলেন জীবনে এবং হয়ে উঠলেন জীবনসঙ্গিনী। ব্যস, সংসারের খাপে খাপ খেয়ে গেলেন সঞ্জীব।

মনের মধ্যে সন্ন্যাসী বাস করলে মানুষকে তা পুরোপুরি স্থির থাকতে দেয় না। তাঁকেও দিল না। সংসার স্থির রইল। অস্থির মনে শুধু চাকরি ছাড়লেন। সংসার আবার থিতু হওয়ার চাপ দিল। যোগ দিলেন আর এক চাকরিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কটেজ অ্যান্ড স্মল স্কেল ইন্ডাস্ট্রিজ ডিপার্টমেন্ট-এ। চাকরিসূত্রে জেলায় জেলায় ঘোরার সুযোগ হল। প্রান্তিক মানুষ থেকে যান্ত্রিক মানুষ, সাদা মানুষ-কালো মানুষ--প্রত্যেকের সঙ্গে মুখোমুখি হবার সুযোগ হল। আর এই যোগাযোগ তাঁর অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার যেমন উপচে দিল, তেমনি ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সাহিত্যিক মনটিকেও উচাটন করে তুলল। এদিকে সমাজে অস্থিরতা দানা বাঁধতে বাঁধতে শুরু হয়ে গেল নকশাল আন্দোলনের খুনোখুনির দিন।তাঁকে কলম ধরতে বাধ্য করল। নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লিখে ফেললেন প্রথম গল্প। সেই গল্প ছাপা হল 'অমৃত' পত্রিকায়। দ্বিতীয় গল্পটিও ছাপা হল সেখানে। তৃতীয় গল্প, 'চকমকি'। সেটি ছাপা হল 'দেশ' পত্রিকায়। গল্পটি প্রকাশিত হতেই সচেতন পাঠকসমাজ ও উদার সাহিত্যিকসমাজ যেন নড়েচড়ে বসলেন। গল্পটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে সঞ্জীব বলেছেন, "আমারই এক মহিলা সহকর্মীকে নিয়ে লেখা। গল্পটি বেরনোর পর শ্রদ্ধেয় গজেন মিত্র মহাশয়, বিমল মিত্র, প্রেমেন্দ্র মিত্র—এঁরা সবাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেশে চিঠি লিখলেন—‘মনে হচ্ছে যেন, একজন নতুন লেখকের আবির্ভাব হল।" সেই নতুন লেখকটি অগ্রজদের মান রাখলেন। পাঠকের প্রত্যাশা পূরণ করলেন।

সাড়াজাগানো 'পায়রা' উপন্যাস দিয়ে ঔপন্যাসিক হিসেবে হল অচিরেই তাঁর আত্মপ্রকাশ। তারপর 'দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হল তাঁর বিখ্যাত আত্মজৈবনিক উপন্যাস, 'লোটাকম্বল'। যা তাঁকে পৌঁছে দিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ততদিনে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে হয়ে গেছেন আনন্দ বাজারের চাকুরে। হয়ে উঠেছেন পূর্ণসময়ের সাহিত্যিক। সাহিত্যসাধনার একদিকে 'মাপা হাসি চাপা কান্না'য় পুনরুজ্জীবিত করলেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের স্যাটায়ার-হিউমারের ক্ষীয়মান ধারাটিকে; অন্যদিকে সাহিত্যের অঙ্গনে কালকূট নবদৃষ্টিতে পুরাণ-পুননির্মানের যে ঐতিহ্য তৈরি করেছিলেন, তাকেও বয়ে নিয়ে যাওয়ার ভার হাতে তুলে নিলেন। সেইসঙ্গে বাঙালি পাঠক তাঁর ভাষায় পেলেন নিজস্বতার স্পর্শ; যা শুরু থেকেই ছিল তাঁর অন্তর্গত। কমলকুমার মজুমদারের মতোই তাঁর ভাষা বলে দেয় লেখকের নাম। লেখক বয়সে অশীতিপর; কিন্তু তাঁর লেখনির একটি বড় প্রসাদগুণ : তা  চির সবুজ, চির নবীন। 'পায়রা', 'শ্বেত পাথরের টেবিল', 'দুই দরজা', 'হেঁটমুণ্ড ঊর্ধপদ', 'রুকুসুকু', 'অনন্ত জীবনের জীবনী', 'পরম পদকমলে', 'শ্রীকৃষ্ণের শেষ কটা দিন'-এর লেখকের সেই অনিন্দ্যসুন্দর চির নবীন লেখনি বয়ে চলুক অনন্তধারায়, তাঁর জন্মতিথিতে এটুকুই আমাদের প্রার্থনা...

 

 

তথ্যঋণ : সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার, 'আজকাল' পত্রিকা, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...