মনসা পুজোয় ছাগল ভেড়ার পাশপাশি বলি দেওয়া হয় হাঁসের!

নদী-নলা-খাল-বিলে সমৃদ্ধ বাংলা। এক হয়ে গেছে জল আর জীবন। বাঘ আর সাপের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা। বাঘ নয় বনে থাকে। কিন্তু সাপ তো সর্বত্র। বর্ষা এল তো সঙ্গে নিয়ে এল সাপের ভয়। লোহার তৈরি বাসরেও ছিদ্র খুঁজে ঢুকে পড়ে ঘরে। কালনাগিনীর দংশনে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে লখীন্দর। হাহাকার করে সনকা। আর গাঙে ভেসে যায় বেহুলার ভেলা। পুত্রশোকেও অনড় চাঁদবণিক শেষ পর্যন্ত হার মানে চ্যাংমুড়ি কানীর জেদের কাছে। বাঁ-হাত দিয়ে পুজো করে শিবকন্যার। বাংলার ঘরে ঘরে আসন পাতা হয় মা মা বিষহরির।

সর্পদেবী হিসেবে মনসার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অথর্ববেদে। পুরাণে তাঁকে ঋষি কাশ্যপ ও নাগ-জননী কদ্রুর কন্যা বলা হয়েছে। খ্রিস্টীয় ১৪শ শতাব্দী নাগাদ মনসা প্রজনন ও বিবাহের দেবী হিসেবে চিহ্নিত হন এবং শিবের আত্মীয় হিসেবে শৈব দেবমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত হন।

প্রতি শ্রাবণের শেষ দিনে মনসা পুজোয় মেতে ওঠে বঙ্গ। বিশেষ করে গাঁ বাংলা। মনসা পুজো শুধুমাত্র ধর্মীয় রীতি রেওয়াজ নয়। মনসার আরাধনা মিশেছে বঙ্গের সাহিত্য সংস্কৃতি লোকাচারে। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে বারবার উঠে এসেছেন দেবী মনসা। বাংলা ভাষায় মনসা নিয়ে লিখেছেন কেতকা দাস ক্ষেমানন্দ, নারায়ণ দত্ত, বিজয়গুপ্ত, কানাহরি দত্তরা। সাপের দেবী মনসাকে নিয়ে যত গান আছে, আর কোনও দেবীকে বা তার বাহনকে নিয়ে বোধ হয় তা নেই।

সাপের ভয়, সাপ বিপদে মুক্তি থেকে শুরু করে প্রজনন! একাধিক কারণে এই দেবীর পুজো করা হয় হলেই প্রচলিত রয়েছে। শ্রাবণের শেষদিন অর্থাৎ শ্রাবণ সংক্রান্তি বা আষাঢ়ী পঞ্চমী তিথিতে নাগপঞ্চমীর পুজো হয়। তাল থেকে শুরু করে সাবু, দুধ, কলা – একাধিক উপাচারে পূজিত হন দেবী মনসা। আবার সাপ্তাহিক পুজোর বিধিও আছে। দশহরাতেও পুজো করা হয় দেবী মনসার। রাঢ়বঙ্গের বেশ কিছু অঞ্চলে ভাদ্র মাসে অরন্ধন করে। তাকেও মনসা পুজো অরন্ধন বলে। সাপ আর লোকাচার মনসামঙ্গল থেকেই প্রচলিত।

বন্দিলাম বন্দিলাম মাগো যন্ত্রে দিয়া ঘা |

অবধান কর মাগো জগৎ গৌরী মা ||

হংস বাহনে বন্দম দেবী পদ্মাবতী |

অষ্টনাগ সহিত মা এস শীঘ্র গতি ||

দুই হংস দুই দিকে মধ্যে অজগর |

নাগছত্র শোভিছে যার মাথার উপর

দেবী মনসা অন্তজ সম্প্রদায়ের দেবী। সমাজের উচ্চশ্রেণিতে পুজো লাভের জন্য তাঁর প্রয়োজন হয়েছিল চাঁদ সওদাগরকে। একাধিক নামে তিনি পরিচিত।

মনসার দ্বাদশটি নাম আছে। জরৎকারু, জগদ্গৌরি, মনসা, সিদ্ধ যোগিনী, বৈষ্ণবী,নাগ ভগিনী, শৈবী, নাগেশ্বরী, জরৎকারু-প্রিয়া, আস্তিক-মাতা, বিষহরী, মহাজ্ঞানযুতা। এই বারো নাম ছাড়াও রাঢ়বঙ্গে তিনি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। বিশেষ করে বাঁকুড়া ও বীরভূম অঞ্চলে।

যেমন, চিন্তামণি , জলডুবুরি , বিষহরি , পদ্মা বা পদ্মাকুমারী , বুড়িমা, দুলালের মা ইত্যাদি। দেবী মনসা প্রান্তিক মানুষের ঘরের মেয়ে। ভয় আর ভক্তি দুই কাজ করে। তাঁর আয়োজনে চোখ ঝলসানো ঝাঁক নেই। বাংলার মাঠঘাট, জলা, জঙ্গলে পাওয়া উপাচারেও পূজিতা হন তিনি। উপাচার বদলে যায় অঞ্চল ভেদে। মনসা জনম দুঃখিনী। অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা, নিপীড়ন তাঁকে করে তুলেছে ক্রুর। দেবীর আসনে সমমর্যাদা আদায় করে নিতে হয়েছে লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে।

সেই কারণেও মনসা হয়ে উঠেছেন ঘরের মেয়ে। ধনী বাড়ির পুজোতে দেব দর্শনের উপায় যাদের নেই তাদের ঘরের দেবী।

ঘটে বসো গো মা, পদুমা (পদ্মের ওপরে) কুমারি

তোমারই স্মরণ লয়ে আনতে যাব বারি।

ছোট বড় গুণিন মাগো বন্দিলাম চরণ

তার আগে বন্দি মাগো তোমার এ চরণ॥

 

আরাধ্য মনসা কেবল সর্পদেবী নন, কৃষি-সমৃদ্ধির দেবীও বটে। কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িয়েই শ্রাবণ সংক্রান্তির মনসা পুজোর চল। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে ভাল ফসল লাভের আশায় আরাধনা করা হয় মনসার।  

শুরুতে প্রধানত সরীসৃপ ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার লক্ষে মনসা পুজো করা হত বলে গবেষকদের একাংশের মত। গৃহস্থ বাড়ির উঠোন কিংবা ছাদে ফনি মনসা গাছ লাগিয়ে মনসা পুজো করা হয়। সেই অংশই বাড়ির ‘মনসার থান’। পোড়া মাটির হাতি ঘোড়া রাখা হয় সেখানে।

জঙ্গলমহলের মনসাপুজোয় শ্রাবণ সংক্রান্তির দিন পুকুর বা জলাশয় থেকে ঘট ভরে জল আনতে যান ‘দেহুরি’ বা পুরোহিত। অনেক পরিবারে গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীই ‘দেহুরি’ হন। দলবেঁধে গ্রামবাসীরা দেহুরির সঙ্গে জলাশয়ে যান। ফেরার পথে ‘সাখি’ গান দেহুরি। দেবী মনসাকে নিয়ে বাঁধা এ-সব গানে থাকে নানা ধাঁধা। পাল্টা গানে দেহুরির ধাঁধার জবাব দেন গ্রামবাসীরা। এর পর শালুক ফুল, চিঁড়ে-কলা-দুধ ও কালিয়াকড়া নামের একটি বিষফল দিয়ে নৈবেদ্য সাজিয়ে দেবীর পুজো হয়। ১৬ প্রহরে ১৬ বার পুজোর সঙ্গে চলে মনসার বন্দনা-গান।

যে পুজোয় বলি হয়, সেটি আমিষ পুজো। এমন পুজোয় পায়রা, হাঁস, ভেড়া, পাঁঠা বলি দেওয়ার রেওয়াজও রয়েছে। শ্রাবণ সংক্রান্তির বিকেলে ঝাঁপান-উৎসব হয়। সর্প-উপাসকরা গায়ে সাপ জড়িয়ে নানা ধরনের কসরৎ দেখান।

সরস্বতীর মতো দেবী মনসার বাহন হাঁস। মনসা পুজোয় ছাগল ভেড়ার পাশপাশি বলি দেওয়া হয় হাঁসের। অনেকের ছাগল বা ভেড়া কেনার সামর্থ্য না থাকলেও একটি হাঁস কিনে মা মনসার কাছে বলি দেবেনই, এটাই নিয়ম।নসার কাছে হাঁস বলি দিয়ে পরের দিন হয় ভুরিভোজ। এই দিনটাকে বলা হয় পান্না। মনসা পূজাকে তাই পুরুলিয়ার মানুষ 'হাঁসের পরব' বলে থাকেন।

রাঢ়বাংলার বাঁকুড়ায় প্রায় প্রতিটি হিন্দু-ঘরে মনসা দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বাঁকুড়া শহরের কাছে দ্বারকেশ্বর নদের বাম দিকে অবস্থিত প্রাচীন শৈবক্ষেত্র এক্তেশ্বরে দ্বাদশ-ভুজ বিষ্ণু মতান্তরে বাসুকির মূর্তিটিকে লৌকিক দেবী ‘খাঁদারাণি’ ও মনসা দেবী হিসেবে পুজো করা হয়।

একই ছবি দেখা যায় হাওড়াতেও। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ঘরে ঘরে মনসা পুজো হয়। তবে মূর্তি পুজোর পরিবর্তে ফনি মনসাকেই দেবী হিসেবে পুজোর রেওয়াজ ছিল। এখন অবশ্য মূর্তিতে পুজো নয়। অনুষ্ঠিত হয় অরন্ধন উৎসব। পান্তাভাত আর ইলিশ মাছ তার আবশ্যিক অনুসঙ্গ। অনেকের বাড়িতে আবার ফলের উপাচারেও পুজো হয়। অত্যন্ত শুদ্ধাচারে এই পুজো হয়। সামান্য বিচ্যুতিতেও দেবী রুষ্ট হলে গৃহস্থের অনিষ্ট হয়। কোথাও সাপের ছবি আঁকা ঘট কিংবা ঝাঁপিতেও পুজো করা হয়।

মনসা পুজোকে ঘিরে আজও ব্যাপক উন্মাদনা লক্ষ্য করা যায় জলপাইগুড়ি ও পার্শ্ববর্তী কোচবিহার জেলার মানুষের মধ্যে।জলপাইগুড়ির বৈকুষ্ঠপুর রাজবাড়ির মনসাপুজোর বয়স পাঁচশো পেরিয়েছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...