ডিজনির পৃথিবী

১৯১৮ সাল। শুরু হয়ে গেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আমেরিকার রেড ক্রস সংস্থা দুর্যোগ মোকাবিলার কাজে ব্যস্ত। আহতদের সময়মতো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষদের প্রয়োজনমতো সাহায্য করা এইসব কাজ করত এই সংস্থাটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকাবাসীদের এই ধরনের কাজে বাধ্যতামূলক যোগদান করতে হতো। সংস্থার পক্ষ থেকে একজন অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারকে নিয়োগ করা হল যুদ্ধবিধ্বস্ত ফ্রান্স এবং জার্মানির মানুষজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সেই অ্যাম্বুলেন্স চালকের স্বপ্ন তখন ক্যানভাসে আঁকিবুকি কাটছে। খবরের কাগজে কার্টুনিস্ট হওয়ার স্বপ্নের হাতছানি তাঁর কাছে। কিন্তু বাধ সাধল যুদ্ধের কাজে যোগদানের কর্তব্য। হাতে অ্যাম্বুলেন্সের স্টিয়ারিং থাকলেও মনে শুধুই ছবি আঁকার সূত্র।

তবে শখ আর টানাপোড়েনের এই দ্বন্দ্বে পড়ে হারিয়ে যায়নি কার্টুনিস্ট হওয়ার স্বপ্ন। আমাদের শৈশবকে ঝলমল করিয়ে দেবার জনক ওয়াল্ট ডিজনি তাঁর কর্তব্য সম্পন্ন করে মনোনিবেশ করেছিলেন অ্যানিমেশন জগতে প্রবেশ করার লক্ষ্যের প্রতি।যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরিতে থাকার সময়েই আঁকার প্রতি অদম্য টান অনুভব করেছিলেন। কিন্তু তাকে বাস্তবায়িত করার আগেই বাবার সঙ্গে সংবাদপত্র বিলি করার কাজে যুক্ত হতে হয়। তারপর কর্তব্যের ডাক আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে।

নিজের স্মৃতিচারণায় ডিজনি বলেছিলেন শৈশবের শৃঙ্খলা এবং পরিশ্রম তাঁকে আরো বেশি দৃঢ় হতে সাহায্য করেছিল। এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষদের যখন অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যেতেন, তখন তাঁদের চোখেমুখে কষ্টের চিহ্ন দেখে সকলকে আনন্দ দেওয়ার আরো বেশি তাগিদ অনুভব করতেন তিনি।

যুদ্ধে নিজের কর্তব্য সম্পন্ন করে ডিজনি বুঝতে পেরেছিলেন, যুদ্ধ শুধু কেড়ে নেয়। ফেরত দেয় না। যুদ্ধও জীবনে প্রভাব ফেলে, তবে নেতিবাচক। নিজের আঁকার প্রতিভার মাধ্যমে তিনি এমন কিছু খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন যা আনন্দ দিতে পারে। এমন কিছু যা সারল্যে মাখানো, সহজ, সরল, যে কোন সময়েই পৌঁছে দিতে পারে শৈশবের দোরগোড়ায়। জন্ম নিল মিকি মাউস, ডোনাল্ড ডাক, মিনির মত শৈশবের হীরকেরা।

ওয়াল্ট ডিজনি মানে যেন অন্য একটা জগত। নীল, সবুজ, হলুদ, লাল সব রং মাখানো তাতে। আমাদের শৈশবের দিনগুলো রামধনুর রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার জনক ওয়াল্ট ডিজনি।

১৯১৯ সাল। এদিকে যুদ্ধে কর্তব্যের কাজ শেষ হল ওয়াল্ট ডিজনির। কিন্তু ওই সময়টা ডিজনির মনের গভীরে ছাপ ফেলেছিল। তাঁর আঙুলের ডগায় তখন রঙিন ছবিরা উঁকি দিচ্ছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির কষ্ট তাঁকে ক্যানভাসে ডাকছিল। যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেওয়ার ছবি আঁকার জন্য। খুশির হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া কোন কিছু সৃষ্টি করার আকুতি তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল আমেরিকার কানসাস শহরের একটা স্টুডিওয়।

সেখানে আলাপ হয় ইউবি আইওয়ের্ক নামে এক চিত্রশিল্পীর সঙ্গে। প্রথমদিকে দুজনেই ওই স্টুডিওতে কাজ করলেও পরে তাঁরা প্রথমবার নিজেদের স্টুডিও খোলেন। সেখানেই জন্ম হয় আমাদের সকলের ছেলেবেলার রঙিন দিনের। অ্যানিমেশন জগতের সূত্রপাত হয় ওখানে। 'অ্যালিস ইন কার্টুন ল্যান্ড'। প্রথম অ্যানিমেশন সিনেমা।

কিন্তু একজন প্রযোজক ঠকিয়েছিল ওয়াল্ট ডিজনি এবং তাঁর বন্ধু ইউবি আইওয়ের্ককে। দেউলিয়া হয়ে যান ডিজনি এবং তাঁর বন্ধু।

ডিজনির এক ভাই তখন তাঁদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। হলিউড জগতে অ্যানিমেশন সিনেমা দাপিয়ে বেড়াতো এই কার্টুনিস্টের হাত ধরে। আজও আমাদের শৈশবের টুকরো টুকরো স্মৃতি বয়ে বেড়ায় ডিজনির কার্টুন চরিত্রগুলো।

প্রথমে সাদা-কালো ছিল অ্যানিমেশন সিনেমাগুলো। তারপর রং আসে। সৃজনশীল মানুষদের সহযোগিতায় ডিজনি অ্যানিমেশন জগতের রাজা হয়ে উঠেছিলেন। সেই রাজত্বে আজও আমরা খুশি। ১৯৫৫ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস তিনি বাচ্চাদের মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি করেন ডিজনিল্যান্ড।

বিপুল সাড়া পেয়েছিলেন ওই ডিজনিল্যান্ডে। যুদ্ধে আহত হওয়া শিশুদের চোখে যন্ত্রণার হাতছানি বারবার ওয়াল্ট ডিজনিকে শৈশবের আনন্দ ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করার আহ্বান জানাত। তাই ফ্লোরিডায় আরেকটি ডিজনি ওয়ার্ল্ড তৈরি করা শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষটা দেখে যেতে পারেননি। ১৯৭১ সালের
১৫ই ডিসেম্বের যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন, ওই ডিজনি ওয়ার্ল্ড তখনো সম্পূর্ণভাবে তৈরি হয়নি। তবে আমাদের শৈশবকে সম্পূর্ণ করে রাখার সমস্ত উপাদানই ততদিনে পৃথিবীতে উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...