স্মরণে অনন্য শেরপা

তাঁকে তুলনা করা যেতে পারে মহাভারতের অর্জুনের সঙ্গে। পঞ্চ পাণ্ডব ও কৌরবদের গুরু আশ্রম। চলছে গুরুর শিক্ষা। একদিন রাত হয়েছে অনেক। এক শত চার ভাই ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন। তবুও গুরু দ্রোণাচার্য দেখলেন অনবরত ব্যর্থ হওয়া সত্বেও, একজন হাত থেকে নামায়নি তাঁর ধনুর্বান। লক্ষ্যে অবিচল থেকে চলছে সাধনা, যতক্ষণ না পর্যন্ত তাঁর তির বিঁধতে পারছে লক্ষ্যবস্তু কে। তিনিই তো পরবর্তীতে হবেন কুরুক্ষেত্রের নায়ক।

এক্ষেত্রে তথাকথিত ধনুর্বান হাতে না হলেও, ছিল অনড় লক্ষ্য। একদিন গোটা পৃথিবীর চূড়োয় উঠে দাঁড়াবেন তিনি। দেখবেন গোটা পৃথিবীকে, পৃথিবীর মাথা থেকে। তবে লক্ষ্য ভেদের রাস্তা তো এত সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। তার জন্য প্রয়োজন অধ্যবসায়। প্রয়োজন ব্যর্থতা সত্বেও অবিচল থাকা নিজের লক্ষ্যে। তবে আঁকা বাঁকা রাস্তার শেষে খুঁজে পাওয়া যায় সাফল্য কে। তিনি পাহাড়ের সন্তান। জন্ম ও বেড়ে ওঠা সেখানেই। জানা ছিলনা নিজের জন্ম তারিখ। তবুও দেখেছেন স্বপ্ন। ছোট থেকেই দেখতেন মাথার উপরে ছাতার মত সেই দৈত্যাকার পর্বত টিকে। পৃথিবীর জননী বলা হয় তাকে। নেপালিরা বলেন সাগরমাথা। তিব্বতিরা বলেন চোমোলাংমা। পৃথিবীর কাছে মাউন্ট এভারেস্ট।

অন্যকিছু করার তাগিদ বরাবরই টেনেছে তাকে। বৌদ্ধমঠে লামা হওয়ার শিক্ষানবিশি অপূর্ণ রেখেই পালিয়েছিলেন। তখন ১৯৩৫ সাল। এবারে আর ফেরাতে পারলেন না পাহাড়ের ডাক। দায়িত্ব পেলেন মালবাহকের। প্রতিদিন তুলতে হয়েছিল নব্বই পাউন্ড মাল। বরফে বইতে হয়েছে পঞ্চাশ পাউন্ড । আর কাজের ফাঁকে ফাঁকেই চলছিল পর্বতারোহণের কলাকৌশল রপ্ত করা। দলটি এভারেস্টের বাইশ হাজার ফুট উঁচুতে পৌঁছতে সক্ষম হয়। প্রথম এভারেস্ট যাত্রায় দাড়ি পড়ে সেখানেই।

এরপরের অভিযান গিয়ে থেমেছিল আরও দুই হাজার ফুট উচ্চতায়। তৃতীয় অভিযানে বাঁধা দেয় তুষারপাত। এবারে মাত্র সতেরো হাজার ফুট উঁচু থেকে ফিরে আসতে হয়। চতুর্থ অভিযানের প্রাপ্তি ছিল সাতাশ হাজার ফুট আর সঙ্গে টাইগার উপাধি। অনেক শেরপাই হাল ছাড়লেন। কিন্তু তিনি তবুও অটল। আসলে ওই চূড়াই তখন হয়ে উঠেছিল তার ধ্যান। তার পর্বত অভিযানের পাতায় পাতায় লেখা আছে মৃত্যু, সঙ্গী হারানোর বেদনা। নিজেও মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন বহুবার। পর্বত যে বড় নিষ্ঠুর! সে প্রাণ কেড়ে নেয় মুহূর্তে। ধীরে ধীরে এগোচ্ছেন সেই প্রতিক্ষিত সময়ের দিকে। ১৯৫২ সালে। পঞ্চম মাউন্ট এভারেস্ট অভিযান। সে ও তার সঙ্গী ল্যাম্বার্ট ৮,৬০০ মিটার পর্যন্ত উঁচুতে উঠতে সক্ষম হন। এটি ইতিহাসে রেকর্ডে পরিণত হয়েছিল। আর এই অভিযানই এনে দিলো তাকে সর্বপ্রথম অভিযাত্রীর মর্যাদা।

এরপরের আয়োজনটি ছিল বিশাল। এবার যেন জয় অনিবার্য। ব্রিটিশ এই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন জন হান্ট। ছিলেন এডমন্ড হিলারিসহ আরও নির্ভীক পর্বতারোহী। বিপত্তি বাধে অক্সিজেন সরবরাহকারী ব্যবস্থায়। ফিরে আসতে বাধ্য হয় এক দল। এই অবস্থায় দলপতি হান্ট তাকে ও হিলারিকে শৃঙ্গ জয়ের জন্য এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এরপরের যাত্রা শুধুই হিলারি ও তার। বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখেন এই দুই পর্বতারোহী। সেই ব্যক্তি হলেন তেনজিং নোরগে।

গিরিচূড়ায় পনেরো মিনিট অবস্থান করেন তারা। তেনজিংয়ের ছবি তোলেন হিলারি। ছবিতে তেনজিংয়ের হাতে ছিল একটি বরফ কুঠার। কুঠারে লাগানো ছিল জাতিসংঘ, ভারত, নেপাল ও ইংল্যান্ডের পতাকা। কোনও কারণে নিজের ছবি তুলতে দেননি হিলারি। পর্বতশৃঙ্গে পৌঁছানোর প্রমাণস্বরূপ আরও কিছু ছবি তুলে সফলভাবে ফিরে আসেন তারা। পরবর্তীতে হিলারি ও হান্টকে নাইট উপাধি দেওয়া হয়। তেনজিং পান জর্জ পদক।এই নির্ভীক ও জেদী পর্বতারোহী কে তাঁর চলে যাওয়ার দিনে প্রণাম। প্রণাম তার সাহসী একাগ্রতা কে।আসলে কিছু মানুষ থাকেন যারা ঠিকানাহীন। নিজের ঠিকানা তারা নিজেরাই খুঁজে পান অথবা তৈরি করেন। তেমনই এক উদাহরণ তেনজিং।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...