Remembering  Sambhu Mitra

জীবন নাটকের দিক নির্দেশক শম্ভু মিত্র

ইচ্ছাপত্র-এ তিনি লিখেছিলেন, "মোট কথা আমি সামান্য মানুষ, জীবনের অনেক জিনিস এড়িয়ে চলেছি, তাই মরবার পরেও আমার দেহটা যেন তেমনই নীরবে, একটু ভদ্রতার সঙ্গে, সামান্য বেশে, বেশ একটু নির্লিপ্তির সঙ্গে গিয়ে পুড়ে যেতে পারে।" 

সৎকার না হওয়া পর্যন্ত যার মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি চাপা হয়েছিল, সাধারণ থাকতে চাওয়ার মধ্যে এই অসাধারণ প্রতিভার নাম শম্ভু মিত্র।গিরিশ ঘোষের পর নট-নাট্যকার হিসেবে মঞ্চে যার অবিসংবাদিত উপস্থিতি।

 'শরৎ' আলোর অঞ্জলি গায়ে মেখে 'শতদল বাসিনী' শম্ভু। ভালো ছাত্র তো বরাবরই তবু শরীর ও স্বরচর্চার অভ্যাসটা ছোট থেকেই। পাশের বাড়িতে 'আলমগীর' নাটকের রেকর্ড বাজছে। "মনে হল যেন শ্যামের বাঁশি বাজল। নাটক ছাড়া আমার গত্যন্তর নেই।" এই ছিল নাটক নিয়ে তার প্রাথমিক উচ্ছাস। অগত্যা মিত্র বাবু তার জীবনের রূপকে ফুটিয়ে তোলার জন্য হানা দিলেন 'রংমহলে', সেখানে ঘটলো 'উলুখাগড়া'র 'সংক্রমণ',তাই তিনি ভাবলেন- চলমন 'নাট্য নিকেতন'। সেখানে গিয়ে তিনি শিশির স্নাত হলেন, 'আলমগীর'এর মত মঞ্চ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তবুও হৃদয় ভরল না, মন যেন আর চলছে না সোজা পথে তাই বামের রাস্তা ধরে তিনি পাড়ি জমালেন নাটকের 'ল্যাবরেটরী'তে। নিজের 'জবানবন্দি' দিলেন নিজেই।

'নবান্ন' এর গান মুখরিত হওয়ার আগেই মনের 'আগুন' এ 'ধরতি কা লাল' হয়ে গেল চারদিক। এবার অশান্ত হৃদয়ে কিছুটা তৃপ্তি পেলেন শম্ভু। তারপর 'মধুবংশীর গলি' থেকে বেরিয়ে 'রাজপথে' এসে বসলেন  তার নাটকের 'বিভাব' নিয়ে। পথ হারা 'পথিক' এর 'ছেঁড়া তার' জুড়ে গেল 'চার অধ্যায়'এর রঙ্গমঞ্চে। যেখানে নাটকের কুশীলবেরা 'মুক্তধারা'র আলোকমালায় 'পুতুল খেলা' করে। সেখানে বিসর্জনের বাজনা বেজে উঠার আগেই 'কাঞ্চন রঙ্গ'এ দেখা যায় সুসজ্জিত রঙ্গমঞ্চ। সেই সুস্পষ্ট স্পটলাইটের রেখা ধরে 'পাগলা ঘোড়া'য় চেপে এগিয়ে আসেন 'রাজা অয়দিপাউস'। এক অব্যক্ত যন্ত্রণার 'রক্তকরবী' গেঁথে নিয়ে 'রাজা' চলেছেন আত্ম বিচারের আশায়। 'বাকি ইতিহাস' থেকে থেকে কেবলই আওয়াজ তোলে 'চোপ আদালত চলছে'। যেন এক স্বপ্নের ফেরিওয়ালা বেরিয়েছেন জীবনের ঘাটে ঘাটে তাইতো শম্ভুর স্বগতোক্তি-'স্বপ্ন তো দেখতেই হবে। স্বপ্নগুলো সব কাচের মতো ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। আবার সেগুলো তো জড়ো করতে হবে'।

            তার যাত্রাপথ তো বরাবরই কঠিন। পিছিয়ে পড়েছেন আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন তার নিজস্ব মহিমায়। নিজের এই যাত্রাপথের কথা বলতে গিয়ে তিনি রসিকতা করে বলতেন, "একটা কেন্নো অন্ধের মতো কেবলই বাঁচবার চেষ্টা করছে, আর কেউ কাঠি দিয়ে তাকে নর্দমার মধ্যে ফেলে দিতে চাইছে। আবার সে শক্তি সংগ্রহ করে ওপরে উঠে আসছে। আবার কেউ তাকে ফেলে দিচ্ছে। এই রকম করেই তো বাঁচা।" এই রসিকতার মধ্যে কোথাও কি লুকিয়ে আছে অভিমান? অভিমানী শম্ভু পদে পদে আঘাতপ্রাপ্ত শম্ভু তাই নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন 'গ্যালিলিও'র জীবন। তার জীবন ও নাটক কে এক অভিন্ন করে তুলেছিলেন তার নিজস্ব মুন্সিয়ানায়।

শম্ভু মিত্রের নির্দেশনা বাংলা মঞ্চের প্রচলিত ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। ইউরোপীয় প্রসেনিয়াম থিয়েটারের আদলে চৌরঙ্গী থেকে বেলগাছিয়া, পাইকপাড়া, পাথুরেঘাটা এবং অনেক ধনী ব্যক্তির নাটমন্দিরে যে-ধারা ও রীতিতে অভিনয় হতো তা তিনি বদলে সম্পূর্ণ নতুন এক আঙ্গিক প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি সৃজনে উৎকর্ষকে প্রাধান্য দিলেন এবং মঞ্চের বিন্যাস, আলো, পোশাক, ভাষা, উচ্চারণ বা স্বরক্ষেপণে পূর্বজদের রীতিকে ভেঙে দিলেন এবং মঞ্চের বিন্যাসে এমন এক শিল্পিত পরিপ্রেক্ষিতের স্পর্শ দিলেন যা ছিল সম্পূর্ণ নতুন। এ নিয়ে তিনি বহু ভেবেছেন এবং এক রূপকল্পে নাটকের অন্তর্নিহিত শক্তিকে ধরতে চেয়েছিলেন, যা ছিল অনেক দিক থেকে সংবেদনশক্তিতে তীব্র ও উজ্জ্বল।

শম্ভু মিত্রের ভেতর অঙ্গীকার ছিল, ভিন্ন আদর্শ ছিল। মনের প্রচন্ড শক্তি ছিল তার মঞ্চ সফলতার চাবিকাঠি। তাই তো নিজের প্রাণশক্তির তীব্রতা নিয়ে প্রবল প্রতাপে ঘোষিত হয় 'চাঁদ বণিকের পালা'। তবে কালে কালে 'বহুরূপী'র রুপ পুড়লো। তারপর 'নাথবতী অনাথবৎ' হয়ে মেয়ের সঙ্গে চললেন নব জীবনের সন্ধানে। দৃষ্টিহীনতার মধ্যেও 'চাণক্য' এর পাঠ শেখালেন নাটকের মঞ্চে। কেননা তার 'কথা অমৃত সমান'। জীবন চক্রের শেষ পথে এসে 'দশচক্র'এ পড়ে তার জীবন নাটকের যবনিকা পতন। ধীরে ধীরে স্পটলাইটের আলো কমে আসছে উইংস এর পাশ দিয়ে চলে যায় অন্ধকারের ছায়ামূর্তি। সেখান থেকেই শম্ভু মিত্রর ঘোষিত উচ্চারণ- "প্রস্তুত সবাই? হৈ-ঈ-ঈ-য়াঃ। কতো বাঁও জল দেখ। তল নাই?" সেই অতল জলের সন্ধানে রত জীবন নাটকের দিক নির্দেশক শম্ভু মিত্র।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...