আলোকবৃত্তে স্বতন্ত্র ঋতু

‘অমৃতের সাগরে আমি যাব যাব রে’-এই স্বল্পচেনা গানটি তাঁর গলায় এক অন্য মাত্রা পেত। তিনি ঋতু গুহ। রবীন্দ্রনাথের গানের এক ব্যতিক্রমী শিল্পী। ১৯৩৭ সালে নির্মলচন্দ্র গুহঠাকুরতা আর কমলা গুহঠাকুরতার কোলে জন্ম নিয়েছিল এক আশ্চর্য প্রতিভা। নিতান্ত শৈশবেই ঋতু গুহ-র গান শেখার শুরু। প্রথমে ‘গীতবিতান’ ও পরে ‘দক্ষিণী’-তে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতে দীক্ষা। শুভ গুহঠাকুরতা, সুনীল কুমার রায় প্রমুখ দিকপালেদের কাছে যে সুগভীর তালিম তিনি পেয়েছিলেন, সারাজীবন আপন উপলব্ধির ধারায় তাঁকে অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন।

   স্বভাবত স্বতন্ত্র ছিলেন ঋতু। কিছুটা অন্তর্মুখী এই গায়িকা প্রথম আবির্ভাবে জনচিত্তে আসন পেতেছিলেন। কিন্ত্ত প্রচারের আলোয় আলোকিত হতে চাননি কোনোদিন। ১৯৬১-র রবীন্দ্র শতবর্ষে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের গানের যে নিজস্বতা, সুর আর তাল ঠিক থাকলেই তা ধরা দেয় না। এ গানের ভাব আর গায়কী - যার মধ্যে আছে উচ্চারণ, লয়, নিঃশ্বাস ফেলার ও প্রশ্বাস নেবার সুনির্দিষ্ট চলন, তা সঠিক ভাবে অনুসরণ সহজ কাজ নয়। আরও কঠিন এত রীতিনিয়ম মানার পরও তাতে নিজস্বতার অনুরণন তোলা। সেই কাজটি অনায়াসে করতে পারতেন ঋতু গুহ। ‘দক্ষিণী’ প্রতিষ্ঠাতা শুভ গুহঠাকুরতার ভ্রাতুষ্পুত্রী ঋতু গুহ-র প্রথম রেকর্ডের গান দুটি ছিল ‘আকাশে আজ কোন চরণের আসা-যাওয়া’ আর ‘আজ শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে’। এই রেকর্ড বিষয়ে সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ লিখেছেন, ‘গান শুনে আমার কান জুড়িয়ে গেল। সমস্ত বর্ষাকালটা যেন ময়ূরের কেকাধ্বনি, কেয়াফুলের গন্ধ, কদমফুলের নরম স্নিগ্ধতা, আকাশের মেঘ-গর্জন, জলপড়ার টুপটুপানি সমেত সেই গান দুটির মাধ্যমে আমার ঘরের মধ্যে চলে এল’।

    ১৯৬২ সালে ঋতু গুহ সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ‘দক্ষিণী’-তে গান শিখতে গিয়ে তাঁদের পরিচয়। সুরের যে বন্ধনে তাঁরা বাঁধা পড়েছিলেন ঋতু গুহ-র প্রয়াণ পর্যন্ত তা অটুট ছিল। কী ছিল ঋতু গুহ-র গানে? এমন কোন টান সে গানে ছিল যে তাঁর প্রয়াণের প্রায় দশ বছর পরেও শ্রোতাদের স্মৃতিতে তার রেশ রয়ে গিয়েছে। ছিল এক অতলান্ত গভীরতা। ‘আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা’, ‘এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ প্রাণেশ হে’ ইত্যাদি গানে তাঁর স্বকীয়তার সাক্ষর আজও শ্রোতাদের মুগ্ধ ও আবিষ্ট করে। দেশে – বিদেশে নানান প্রান্তে তিনি অনুষ্ঠান করেছেন। রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গানে ও ভাঙ্গা গানে ঋতু ছিলেন অনবদ্য। প্রচারের আলোকবৃত্ত তাঁকে ছুঁতে পারেনি। প্রখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক পল কক্সের 'আইল্যান্ড’ ফিল্মে তাঁর ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই/ চিরদিন কেন পাই না’ গানটি ধরা আছে। আদ্যন্ত ব্যতিক্রমী এই শিল্পী রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়াও অতুলপ্রসাদ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গানও গেয়েছেন। তাঁর সময়কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়িকা হওয়া সত্ত্বেও অসুস্থতার জন্য জীবনের শেষদিকে তিনি খুব একটা অনুষ্ঠান করতে পারেননি। ২০১১ সালে ২৪ ডিসেম্বর তিনি প্রয়াত হন। রেখে যান তাঁর অজস্র গান। দরদী শ্রোতা যে গানে পাবেন এক অনন্য স্পর্শ, এক আশ্চর্য আবেশ।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...