বাবা-মায়ের সঙ্গীত-সাহচর্য গড়ে দিয়েছিল বালিকা সন্ধ্যার মন

নাহং তিষ্ঠামি বৈকুন্ঠে, যোগীনাং হৃদয়ে চ।

মদ্ভক্তা যত্র গায়ন্তি, তত্র তিষ্ঠামি হে নারদ।।

 

যার অর্থ হল, ‘আমি বৈকুন্ঠে বাস করি না,  যোগী হৃদয়েও বাস করি না, আমার ভক্তগণ যেখানে আমার নাম গায়,  হে নারদ! সেখানেই আমি অবস্থান করি"

সন্ধে হলেই কানে আসত বাবার স্তব পাঠ। মানে বুঝতেন, না কিন্তু কানে লেগে থাকত সেই মধু স্বর। ঈশ্বরের সঙ্গে অনুচ্চার ভালবাসার শুরু সেই লগ্নেই। তখনই যেন স্থির হয়ে গিয়েছিল নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং হেমপ্রভা দেবীর কনিষ্ঠা কন্যার নিয়তি। গানের ভুবনের আসনতলে সপ্তসুরের তানে একদিন আসন পাতবেন সেই ঈশ্বরের। ভারতীয় সঙ্গীতে আকাশে উদিত হবেন ‘সন্ধ্যাতারা’ হয়ে সাধিকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। 

আমার এ গান

IMG-20240216-WA0013

শহর কলকাতার দক্ষিণে ঢাকুরিয়া তখন পাড়া গাঁয়ের দেশ। নগর গন্ধ বেরিয়ে অনেক দূরের এক গ্রাম। সেখানেই ১৬ নম্বর ব্যানার্জি পাড়ায় জন্ম। আসল বাস হুগলির জিরাট। দাদু যোগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন নাম করা পুলিশ সুপারিনটেন্ডেট। তাঁর ডাকাত কাবুর কাহিনি লোকের মুখে মুখে ফিরত একসময়। নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় রেলে চাকরি করতেন। গুরু গম্ভীর স্বভাবের মানুষ। প্রবল ঈশ্বরভক্ত। সঙ্গীতে গভীর গান ছিল। দিনের কাজের বাইরে বাকি সময় মগ্ন থাকতেন আধ্যাত্মিকতায়। স্তব পাঠ করতেন। সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা ছিল। সেই ভালবাসা ছড়িয়ে ছিল তাঁর সন্তানদের মধ্যেও।

চাকরি জীবন থেকে অবসরগ্রহণের পর আরও বেশি করে ডুবে যান ঈশ্বরচর্চায়। সন্তানশোক, সংসার ভার ভুলতে অবলম্বন। জীবনের শেষ কিছু বছর কেটেছিল ঢাকুরিয়ার রামকৃষ্ণ মন্দিরে।

ঠাকুরের আসনের সামনে বসে আনমনে ভক্তিগীতি গেয়ে যেতেন। বাবার সঙ্গে স্তব গাইতেন সন্ধ্যাও। ডাক নামে ‘দুলদুল’ ছোটবেলা থেকে স্পর্শকাতর। ভীষণ ভালবাসতেন আম, কাঁঠাল, পেয়ারা গাছের ছায়ায় ঢাকা ঢাকুরিয়ার জন্মভিটা। বাড়িতে ছিল গানের পরিবেশ। বাড়িতে বাবা-মায়ের গলায় টপ্পা শুনে শুনে গানের কান তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মায়ের কাছে শিখেছিলেন নিধুবাবুর টপ্পা। আর ছিল রেডিয়োতে সব ঢরনের গান শোনার অভ্যাস। ছোটবোনের গানের আগ্রহ দেখে দাদা নিয়ে গেলেন বাড়ির কাছেই সন্তোষভূষণ মল্লিকের কাছে। তারপর যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে ক্ল্যাসিক্যাল। তারপর বড়ে গুলাম আলি, চিন্ময় লাহিড়ি, এটি কানন, বি ডি যোশি, গণপত রাও, মুনাব্বর আলি খানের মতো সঙ্গীত ব্যক্তিত্বরা ছিলেন তাঁর গুরুর তালিকায়।

গানের 

তোমার গরবে গরবিনী হাম

গানের সঙ্গে পেয়েছিলেন ঈশ্বরের যোগ। বাবার সান্নিধ্য বালিকা বয়স থেকে বদলে দিয়েছিল মনোজগত। সারাজীবন সঙ্গীত সাধনাকে ঈশ্বর সাধনার অন্য রূপ হিসেবে দেখেছিলেন। তাই ভক্তির গান তাঁর কণ্ঠে অনুপম মাধুর্য্য পেত। অতি বড় নাস্তিককেও থমকে দিতে পারেন তিনি। বিশেষ করে তাঁর কণ্ঠের কৃষ্ণ ভজন। নিবেদন পর্যায়ের গানে তিনি অনন্য সাধিকা। ১৯৪৩ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে অংশগ্রহণ করেছিলেন ‘অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্স’-এ। সেবার ভজনে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে জন্মাষ্টমীর তিথি তাঁর কাছে ছিল আজীবন বিশেষ।

নাম, যশ, বিশ্বজোড়া খ্যাতির মধ্য গগনে থেকেও চেয়েছিলেন নিভৃতে গভীরতর সঙ্গীত সাধনায় নিজেকে ডুবিয়ে দিতে। সেই পথেই তাঁর প্রচারবিমুখতা, আরবসাগরের তীরে মায়ানগরীর টান উপেক্ষা করে নিজের মাটিতে ফিরে আসা। 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...