লৌকিক ও অলৌকিক বৃত্তান্তে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

দ্বারকানাথ ঠাকুরের তিন পুত্রের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ধর্মপ্রাণ ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজন্ম তিনি সেভাবেই গড়ে ওঠেন। পরে রামমোহন প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের প্রচার ও প্রসারে তিনি কাণ্ডারির ভূমিকা গ্রহণ করেন। এই যে দেবেন্দ্রনাথের ধর্মকেন্দ্রিক জীবনের বৃত্ত, তার পেছনে একটি বাস্তব কাহিনি আছে। সেই কাহিনিতে অলৌকিকতার একটি পরিমণ্ডলও আছে।

জ্যোতিষে দ্বারকানাথের বেশ বিশ্বাস ছিল। যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময় তাঁর বিবাহের বেশ কিছুকাল অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু তখনও সন্তানাদি হয়নি। দ্বারকানাথ তারই মধ্যে একদিন নিজের কোষ্ঠী কয়েকজন জ্যোতিষীকে দিয়ে বিচার করালেন সন্তান হবে কি না, যদি হয় তাহলে সন্তানভাগ্য কেমন হবে—সেটা জানার জন্য। কিন্তু প্রত্যেকেই জানালেন যে, তাঁর সন্তানভাগ্য শুভ নয়। সন্তানের জন্ম হলেও সে স্বল্পায়ু হবে।

কথাটা শুনে বেশ চিন্তায় পড়লেন দ্বারকানাথ। চিন্তিত মুখে বললেন, তাহলে উপায়?

জ্যোতিষীরা তখন তাঁকে একটি যজ্ঞ করার নিদান দিলেন। বললেন, তন্ত্রমতে যজ্ঞ করলেই সমস্ত বাধা কেটে যাবে।

জ্যোতিষীরা নিদান দিলেন বটে, কিন্তু তাতে দ্বারকানাথের ভাবনা দূর হল না। রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে তাঁর তখন সখ্যতা তৈরি হয়েছে। তাই সখার কাছে এই ব্যাপারে পরামর্শ চাইলেন—কী করা যায়! রাজা মত দিলেন যজ্ঞটা করে ফেলার সপক্ষেই। নিজেই ভার নিলেন যজ্ঞের জন্য উপযুক্ত লোক এনে দেবার।

রংপুরে রামমোহনের পরিচিত এক ও বিশ্বস্ত তান্ত্রিক থাকতেন। দেরি না-করে খবর পাঠিয়ে তাকেই তিনি আনিয়ে ফেললেন। সেই তান্ত্রিক এসে নিজে আবার কোষ্ঠী বিচার করতে বসলেন। তাঁর বিচারেও পূর্বের ফলই দেখা গেল। তখন সেই তান্ত্রিক যজ্ঞ করতে সম্মত হলেন। তবে তাঁর একটাই শর্ত, তিনি যজ্ঞ করবেন একান্তে, কেউ তাঁকে কোন প্রশ্ন করতে পারবেন না।

বেশ, তাঁর কথা মেনে নিলেন দ্বারকানাথ। গোয়ালঘরের একটি ফাঁকা স্থানে তাঁকে যজ্ঞের জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করে দিলেন। যোগাড় করে দিলেন যজ্ঞের সমস্ত উপচার। তারপর সেখানেই একান্তে তান্ত্রিক সারারাত যজ্ঞক্রিয়া চালিয়ে গেলেন। পরদিন সকালে তাঁর কাজ শেষ হল।

সারারাত দ্বারকানাথ বৈঠকখানায় উচাটনে অধীর অপেক্ষায় বসে। তারই মাঝে সকালে তান্ত্রিক এসে জানালেন, যজ্ঞ সফল হয়েছে। অচিরেই দ্বারকানাথ দীর্ঘজীবী ও ধার্মিক এক পুত্রের জন্ম দিতে পারবেন। তান্ত্রিকের কথা শুনে তখন তাঁর মুখে হাসি ফুটল। এবং নির্দিষ্ট সময়ে তাঁর পুত্রসন্তানই হল। প্রথম সন্তান। সময়টা ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দ। দ্বারকানাথ সেই পুত্রের নাম দিলেন, ‘দেবেন্দ্রনাথ’। দৈব-সংযোগে জন্ম ও দেবানুসারী হবেন বলেই কি তিনি পুত্রের এমন নাম দিলেন? কে জানে!

বলা বাহুল্য, জন্মের সময় থেকেই দেবেন্দ্রনাথ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন না, রোগভোগও তাঁর বেশ হত; তবে তান্ত্রিকের কথা মতো তিনি কিন্তু দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন। ব্যাপারটা হতেই পারে কাকতালীয়, কিন্তু ফলে গিয়েছিল।

রামমোহন শৈশব থেকেই দেবেন্দ্রনাথকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাঁর ওপর বর্ষণ করতেন বাৎসল্য। সেই ছোট থেকেই তিনি শুরু করেছিলেন তাঁকে সময় দিতে। চেয়েছিলেন নিজের আদর্শের পন্থী করে গড়ে তুলতে। দেবেন্দ্রনাথের মধ্যে সেই শৈশবে তিনি কী দেখেছিলেন যে, তাঁকে ব্রাহ্মধর্মের ভবিষ্যৎ কর্ণধার হিসেবে গড়ে তুলতে এভাবে আত্মনিবেশ করেছিলেন? নাকি, তান্ত্রিকের বাণী তাঁকেও প্রভাবিত করেছিল? যাই হোক, তিনি যোগ্যপাত্রেই যে সেদিন আস্থা রেখেছিলেন, সময়ই তার প্রমাণ দিয়েছে।

রামমোহন ইংল্যান্ডে যখন মারা যান, তখন দেবেন্দ্রনাথ বয়সে নিতান্তই বালক। ফলে, মৃত্যুর আগে ঘটা করে তাঁর হাতে ব্রাহ্মসমাজের সমস্ত দায়দায়িত্ব তুলে দিয়ে যাওয়া রামমোহনের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কেননা, সময় হয়নি, সুযোগও ছিল না। বালকের হাতে কেউ ধর্ম-সংগঠনের দায়িত্ব দিয়ে যায় না। তবে রামমোহন বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুকাল আসন্ন। তাই শেষবারের মতো ইংল্যান্ড যাওয়ার আগে তিনি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। শেষ সাক্ষাৎ। যেভাবে মহাত্মা ধর্মপ্রচারক বা সাধকেরা মৃত্যুর আগে তাঁদের প্রিয় শিষ্যের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করেন, (যিশুর মতো মহাত্মাদের জীবনের তেমনই তো গল্প শুনি) সেই ভাবে।

সেই সাক্ষাতের বিবরণ দেবেন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন। বলেছেন, ‘তখন আমি সামান্য বালক। তথাচ, রাজা আমাকে দেখিতে ইচ্ছা করিলেন। তিনি আমার পিতাকে বলিয়াছিলেন যে, আমার হস্তমর্দন না করিয়া তিনি এ দেশ পরিত্যাগ করিতে পারেন না। আমার পিতা আমাকে ডাকিয়া আনিলেন। তখন রাজা হস্তমর্দন করিয়া ইংল্যান্ড যাত্রা করিলেন। রাজা যে সস্নেহে আমার হস্তধারণ করিয়াছিলেন, তাহার প্রভাব ও অর্থ তখন বুঝিতে পারি নাই। বয়স অধিক হইলে, উহার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছি।’

বয়সকালে কী বুঝেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ? শোনা যায়, সাধকগুরুরা যাঁকে উত্তরাধিকারী করে যান, তাঁর বুকে বা হাতে হাত রেখে সাধনার ধন দান করে যান। দেবেন্দ্রনাথ সেই প্রাপ্তিটুকুই কি উপলব্ধি করেছিলেন পরিণত বয়সে? তারই জোরে বিভক্ত হওয়া, হতে চাওয়ার মাঝে ব্রাহ্মসমাজের মূল ধারাটিকে তিনি অক্ষুন্ন রাখতে পারলেন! গ্রহণে-বর্জনে ক্ষমায়-তিতিক্ষায় লড়াই করে গেলেন চিরটাকাল? সেই জোরে? হতেই পারে…

 

তথ্যঋণঃ ‘ঠাকুরবাড়ির বাহিরমহল’- চিত্রা দেব।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...