বাংলা সাহিত্যজগতে বিমল কর কীভাবে এলেন?

কলকাতার 'আর জি কর মেডিকেল কলেজ'-এর নাম তখন, 'কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ'। 'তখন' মানে, ১৯৩৮-৩৯ সাল। তা, তখন ডাক্তারি পড়তে সেই কারমাইকেল মেডিকেল কলেজেই এলেন বিমল কর। এলেন, হাজারিবাগ থেকে। তাঁরা প্রবাসী বাঙালি। সেখানে রেলের চাকুরে সেজকাকা নগেন্দ্রনাথ বাড়ি করেছেন। বাবা জ্যোতিষচন্দ্রও রেলে, তাঁর হিল্লিদিল্লি ট্রান্সফারের চাকরি। তাই তিনি পরিবারকে কোথাও থিতু করতে পারেননি। ফলে, মাকুর মতো এ-স্কুল ও-স্কুল করে পড়ে বেড়ানোর আপদ শুরু হল বিমলের জীবনে। অবশ্য এ আপদ বেশিদিন সহ্য করতে হল না। ত্রাতা হয়ে এলেন সেজকাকা। তিনি বিমলের হোস্টেলে থেকে পড়ার পাক্কা বন্দোবস্ত করে দিলেন। ছুটিছাটায় সেজকাকার বাড়িই হয়ে উঠল বিমলের আস্তানা। কারণ সে-বাড়ির টান, সেজকাকি। আপন মা-বাপ বহাল তবিয়তে থাকতেও তিনিই একাধারে হয়ে উঠলেন বিমলের জননী ও বন্ধুনি। তিনি শখে কবিতা লিখতেন, পড়তেন প্রচুর। বঙ্কিম-রবীন্দ্র থেকে শুরু করে হালের পত্রিকা। শিশু-কিশোর সাহিত্য থেকে রামায়ণ-মহাভারত সমস্তই বিমলের কাছে পরিচিত হল, আন্তরিক হয়ে উঠল সেজকাকির সুমধুর পাঠে। সাহিত্য আলোচনা তো দুজনে এনতার হতই, স্বরচিত কবিতা নিয়ে আলোচনাও বাদ যেত না। ফলে, সেজকাকির সাহচর্যে বিমলের মনে সাহিত্যিরসের উপলব্ধি যেমন ঘটল, তেমনি মননে সাহিত্যিক হয়ে ওঠার প্রস্তুতিও শুরু হল।

সেই সাহিত্যে পাওয়া ছেলেকে যখন সাহিত্য-নগরী কলকাতা পেয়ে বসল; তখন ডাক্তারি পড়া মাথায় উঠল। সাহিত্যপ্রেমী ও হবুসাহিত্যিক বন্ধু-বান্ধব জুটতেও দেরি হল না। তখন কলকাতাজুড়ে চলছে নানান ছোট পত্রিকার আসরে বাংলা সাহিত্যের দিক বদলের সাধনা। এরকমই এক পত্রিকা, 'পূর্বমেঘ'। তাতে প্রকাশিত হল বিমল কর-এর প্রথম গল্প, 'গিনিপিগ, এস্রাজ ও রাত্রি' (১৯৪২ সালে)। ছোট্ট পত্রিকার পাঠক পরিধিও ছোট। ফলে, প্রথম গল্পটি বুননে-স্বাদে অন্যরকম হলেও, তাঁকে রাতারাতি বিখ্যাত করে তোলার মতো মিরাকল কিছু করল না। মাঝখানে মাঝপথে ডাক্তারি পড়া লাটে উঠল। শেষমেশ বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বিএ পাশ করে পড়াশুনোয় ইতি টানলেন। তবু সেজকাকা তাঁকে বেহাত হতে দিলেন না। বেনারসে টেনে নিয়ে গিয়ে রেলের একাউনট্যান্ট-এর চাকরিতে ঢুকিয়ে দিলেন। কিন্তু, বিমল তাতে হাঁফিয়ে গেলেন, সাহিত্যবিনে নিরস কলমপেষা পোষায়! কোনরকমে চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। শুরু হল 'পরাগ', 'পশ্চিমবঙ্গ', 'সত্যযুগ'-পত্রিকায় সহ-সম্পাদক জীবন। আর লিখলেন 'অম্বিকানাথের মৃত্যু', 'সৈনিক', 'পিয়ারীলাল বার্জ'-এর মতো কথন ও আঙ্গিকে নতুন ধারার ছোটগল্প। তারমধ্যে পিয়ারীলালই তাঁর জীবনের গতিপথে জোয়ার আনল, পালে হাওয়া দিল। কীভাবে? বলছি।

'লেখকের কৈফিয়ৎ'-লেখায় বিমল লিখেছেন, "কাশীতে থাকবার সময় আমি বোধ হয় 'পিয়ারীলাল বার্জ' এর খসড়া করেছিলুম। আমার বন্ধু কবি অরুণ ভট্টাচার্য সেটা এনে 'দ্বন্দ্ব' কাগজে দেয়।" 'দ্বন্দ্ব' ছোট পত্রিকা অর্থাৎ লিটল ম্যাগাজিন। সেটা ১৯৪৮ সাল। সাগরময় ঘোষ তখন 'দেশ' পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত। প্রকৃত প্রতিভাবান লেখক-শিল্পীকে খুঁজে এনে 'দেশ'-এ লেখার সুযোগ করে দিয়ে পত্রিকাটিকে এবং একইসঙ্গে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার কাজে তিনি মশগুল। তিনি বলছেন, "লিটল ম্যাগাজিন' বা প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা যখন যা পাই নতুন লেখকদের গল্প বা উপন্যাস পড়া আমার নেশা। হঠাৎ একটি মাসিক পত্রিকা 'দ্বন্দ্ব' আমার হাতে এসে পড়ল। 'পিয়ারীলাল বার্জ' গল্পটি পড়ে চমকে উঠলাম। লেখক বিমল কর, নিতান্তই অপরিচিত নাম।...বেশ কিছুদিন পর 'উত্তরসূরী' পত্রিকায় বিমল কর-কে আবার খুঁজে পেলাম। তাঁর 'ইঁদুর' গল্পটি পড়ে আমি লাফিয়ে উঠেছি। যে করেই হোক বিমল করকে খুঁজে পেতেই হবে।" বিমল কর-কে খুঁজে নয়, ধরে আনলেন গৌরকিশোর ঘোষ। কারণ, তাঁরা পরস্পর বন্ধু। জহুরী সাগরময় বিমলের সঙ্গে আলাপ করেই বুঝলেন, ইনি সপাট ও শিল্পিত "চাবুক"। ফলে, এই আলাপ থেকেই বিমল একেবারে 'দেশ' ও 'আনন্দ বাজার পত্রিকা'-র নিয়মিত লেখক হয়ে উঠলেন। তাঁর ষাট-পঁয়ষট্টি বছরের দীর্ঘ লেখক জীবনের সিংহভাগ লেখাই প্রকাশিত হল এই দুই পত্রিকায়। 'দেশ' পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হল ১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে, 'বরফ সাহেবের মেয়ে'। অমনি সচেতন পাঠক সচকিত হল। নবীন যদুর পদসঞ্চার দেখতে পেল। বাংলা সাহিত্যে নতুন এক শক্তিশালী লেখকের যেন সগৌরব নবীনবরণ হল। 

দীর্ঘ এই সাহিত্যজীবনে কেমন লিখতেন বিমল কর? আমরা জানি, তাঁর গদ্য সহজসরল-চিত্রকল্পমুখর ও ব্যঞ্জনাময়। তিনি নিজে বলতেন, "সুবোধ ঘোষের অলংকার + বুদ্ধদেব বসুর emotion বুঝলে।" তাঁর প্রথম দিকের লেখায় অনেকেই সুবোধ ঘোষের প্রভাব লক্ষ করেছেন। তিনি নিজেও এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। তাই ভাষাকে নিজস্ব রসায়নে জারিয়ে স্বকীয় করে নিতে তাঁর দেরি হয়নি। সাগরময় তাঁর লেখা সম্পর্কে বলেছেন, "বিমল করের যে-কোন গল্পের মধ্যেই তাঁর মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর ভাষার বৈশিষ্ট্যও তাঁকে আলাদাভাবে চিনিয়ে দেয়। তাঁর ভাষা একদিকে যেমন মধুর, অন্যদিকে তেমনই অনিবার্য। তাঁর গল্পের বিষয় ও ভাষা নিপুণ চিত্রশিল্পীর চিন্তা ও রঙের মতন, সমানভাবে মিলে এক আশ্চর্য সৃষ্টি হয়ে ওঠে। মানুষের মনের মধ্যে ডুব দিয়ে তন্ন তন্ন অনুসন্ধান করে তিনি যে দর্পণটি তুলে ধরেন, তাতে আমরা সকলেই নিজেদের দেখতে পাই। সব রহস্য ও জটিলতা সত্ত্বেও তাঁর গল্পে এমন একটা প্রশান্ত রস থাকে--যাতে সব ক্ষোভ দূর হয়ে যায়...।" 'সুধাময়', 'আত্মজা', 'আঙুরলতা', 'বিষুবরেখা', 'আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন', 'উপাখ্যানমালা', 'সহচরী', 'স্বপ্নের মধ্যে হাঁটা'--প্রভৃতি গল্পের আমরা যারা পাঠক, তারাও সাগরময়ের বক্তব্যের সারবত্তা অনায়াসে বুঝতে পারি। আর বুঝতে পারি, বাংলা গল্পসাহিত্যের ধারায় বিমল কর-এর চিরস্থায়ী আসনটি কোন অনন্যলোকের পাড়ায়...


তথ্যঋণ : 'উড়ো খই'- বিমল কর; 'তীব্র কুঠার'- বিমল কর বিশেষ সংখ্যা, ২০০৩; 'বিমল করে শ্রেষ্ঠ গল্প'- ভূমিকা ও সম্পাদনা- সাগরময় ঘোষ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...