পথের বাঁকে পৃথিবী খুঁজে বেড়ান এক মানুষ

“সংসার যে কি ভয়ানক জায়গা, দুঃখে-কষ্টে

না পড়লে বোঝা যায় না।”

একথা যিনি বলেছিলেন তিনি আদ্যন্ত এক পথের বাঁকে পৃথিবী খুঁজে বেড়ান এক মানুষ। ঘাসফুল, লতা,পাতা, প্রকৃতি আঁকড়ে তাঁর বেঁচে থাকা। ঘেঁটুফুল নাটাফুল জীবনের টানে বারবার পথ ভুলেছেন। উদাসী হাওয়ার টান মোড় বদল করেছে জীবনের। যে জীবন চোখের আড়াল থেকে যায়, তাই দিয়ে মন ছুঁয়ে ছিলেন তিনি। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়।
আলাদা করে ‘মন ছোঁয়া’র দায় তাঁর ছিল না। তিনি লিখেছিলেন নিজের লেখার খুশিতে। যে অপার্থিব মায়া লোক চক্ষুর অন্তরালে এমনিই হারিয়ে যায় তাদের জন্যই যত মন কেমন।
সংসারে থেকেও কোনওদিন বাঁধা পড়েননি সংসারের জটে। তবু সংসারী মানুষের বেদনার বাণে আঘাত এসেছে। কখনও কখনও অসহনীয় হয়েছে সে আঘাত। হতে হয়েছে ঘর ছাড়া। প্রতিবাদ করেননি। ঘর ছেড়ে বেছে নিয়েছেন পথকেই। গদ্যকার হয়েও তিনি পথের কবি।
জীবনের প্রথম চাকরি। জাঙ্গীপাড়ার দ্বারকানাথ হাইস্কুলে। সেখানকার ধনী ব্যবসায়ী মাখনলাল দে’র দানে স্কুল তৈরি হয়েছে তাঁর বাবার নামে।
স্কুল শেষে বসে প্লানচেটের আসর। ছোট্টঘরে ক্রমশ বাড়তে থাকে প্ল্যানচেটে উৎসাহী সদস্যদের সংখ্যা। একদিন ছাড়তে হল সেই স্কুল। আভ্যন্তরীন দলাদলিতে বিপর্যস্ত মন। নিয়ে ফিরে এলেন বাড়িতে।
এমন ঘটনা একবার নয়, বারবার ঘটেছে জীবনে। সাদা মন ম্লান হয়েছে চারপাশের মানুষের ছুঁড়ে দেওয়া কালির কালিমায়। গল্প লিখেছিলেন ‘উপেক্ষিতা’। সেই নিয়ে গুঞ্জন রাজপুর হরিনাভিতে। তাঁর গল্পের নায়িকা কে সেই নিয়ে চলতে লাগল গুঞ্জন। পাড়ার চন্ডী মণ্ডপ থেকে মেয়েমহল সর্বত্র ব্যঙ্গের তির। বিভূতিভূষণ সে নিয়ে ভাবিত নন। প্রবাসী থেকে গল্পের তাগাদা পাঠান চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। গল্প লেখেন ‘ উমারানী’। ফের নতুন আলোড়ন নিস্তরঙ্গ গ্রাম জীবনে।
আবার বন্দর ছাড়ার পালা। ফের ‘রেজিগনেশন’। ফের দুঃসহ বেকার জীবন। অন্তরালে মানুষের আঘাত। বারবার যা আছড়ে পড়েছে লেখক জীবনে।
আঘাতকে জীবনে ধারণ করেও আরণ্যক মানুষটি কিন্তু মানুষের থেকে মুখ ফেরাননি। মানুষকে দেখেছেন পরম মমতায়। ব্যক্তিগত শোক আঘাত যন্ত্রণার উর্ধে উঠে।
আঘাত শোক কষ্ট যেমন সমাজ সংসার থেকে এসেছে তেমনি এসেছে নিয়তির পথেও। স্ত্রীকে হারিয়েছেন। সহদরাকে হারিয়েছেন। মাকে হারিয়েছেন। ভরাট সংসার খাঁ-খাঁ কয়েক বছরের মধ্যে। মন বিবাগি। সন্ন্যাসীর কাছে ছুটে গিয়েছেন অলৌকিকের আশায়।
নাছোড় অর্থকষ্টে ভুগতে হয়েছে। দিশাহীন অসহায় দিন। তবু পথ চলেছেন নিজের মনের বিবাগী চরিত্রেই। আগলখোলা উদাস বাউল। জীবনের রোদ- বৃষ্টি-ঝড় গায়ে মেখেও শিশুর মতো অনাবিল তাঁর পথচলা...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...