"অযান্ত্রিকের" স্রষ্টা

১৯৪০ সালে একটি বাংলা সংবাদপত্রের বার্ষিক দোল সংখ্যায় একটি গল্প প্রকাশিত হয়। গল্পের নাম "অযান্ত্রিক"... নতুন এক লেখকের লেখা... পাঠকেরা পড়ে চমকে উঠলেন। এমন গল্পও লেখা সম্ভব! তারা এর আগে তো এমন গল্প পড়েন নি। একটা পুরনো গাড়িকে প্রধান চরিত্র করে এবং সেই গাড়ির মালিকের সঙ্গে গাড়িটির অদ্ভুত সুন্দর সম্পর্ক নিয়ে তো এর আগে এমন গল্প কেউ লেখেন নি! আর কেউ ভাবতেও পারেনি যে "অযান্ত্রিক"ই এই লেখকের প্রথম রচনা।

সময়টা ১৯৪০ -এর প্রথম দিক। "অনামী সংঘ" নামে লেখকদের বিশেষতঃ তরুণ লেখকদের একটি মজলিশি আড্ডা বসতো বা সমাবেশ বসতো। সেখানে বেশ কয়েকজন লেখক এই ভদ্রলোকের বন্ধুস্থানীয়। সেই সূত্রে তিনি এই বৈঠকে উপস্থিত থাকতেন, গল্পপাঠ শুনতেন এবং চা মিষ্টি খেয়ে চলে যেতেন। একদিন এই নবীন লেখক দল ভদ্রলোককে চেপে ধরে বললেন যে তাঁকে লিখতেই হবে। আর সেই ভদ্রলোক... যিনি কোনোদিনও কোনো গল্প লেখেন নি তিনি কয়েক ঘন্টার মধ্যে লিখে ফেললেন এমন দুটি গল্প যে গল্প দুটি বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় চিরস্থায়ী উজ্জ্বল হয়ে রইল। গল্প দুটির নাম "অযান্ত্রিক" এবং "ফসিল"... সৃষ্টি হল একটি নতুন ধারার এবং পরবর্তী সময়ে ঋত্বিক ঘটকের ছোঁয়ায় "অযান্ত্রিক" এক কালজয়ী ছবিতেও রূপান্তরিত হল। প্রায় একই সঙ্গে "অগ্রণী" পত্রিকায় প্রকাশিত হয় "ফসিল"। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এক দিন সাংবাদিক/সাহিত্যিক সন্তোষ কুমার ঘোষকে ডেকে বলেছিলেন, "এ বারের "অগ্রণী" দেখেছ? পড়েছ "ফসিল" গল্পটা?"

..."এ ভাবে গল্প, এ রকম গল্প বাংলায় বেশি লেখা নেই।’'... বিশিষ্ট এই সাহিত্যিকের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সন্তোষ কুমার ঘোষ আরও বলেছিলেন, ‘'সাহিত্যে প্রথম লেখা দিয়ে ঝড় বইয়ে আর ক’জন দিয়েছেন, আমি তো জানি না। ...সুবোধবাবু তাঁর ছোট্ট ‘অযান্ত্রিক’ আর ‘ফসিল’ লিখেই একেবারে সবকিছু তুমুল করে দিলেন, সেটা আজ ইতিহাস, কীর্তিটাও ঐতিহাসিক।’'

অসম্ভব প্রতিভাবান এই সাহিত্যিকের নাম সুবোধ ঘোষ। তাঁর জন্ম হয়েছিল বিহারের হাজারিবাগে ১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৯০৯।

স্কুলের পাঠ শেষ করে হাজারিবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু অর্থের অভাবে অত্যন্ত মেধাবী এই ছাত্রকেও কলেজ ছাড়তে হয়। নামতে হলো জীবিকার সন্ধানে। হাজারিবাগের কুলিবস্তিতে তখন কলেরা মহামারী আকার নিয়েছে। সুবোধ সেখানে কলেরার টিকা দেওয়ার কাজ পেলেন। এই টিকা দেওয়ার কাজ নিয়ে তাকে এরপর যেতে হয়েছিলো মুম্বাই। সেই কাজ শেষ হওয়ার পর কিছুদিন এক সার্কাস দলে মালপত্র বহনের কাজ করলেন। তারপর কিছুদিন করলেন বাস কন্ডাকটারের কাজ। এরপর কর্পোরেশনের জমাদারের কাজও করেছেন। পাউরুটি কেক দোকানে সাপ্লায়ারের কাজ, মুরগী পালন, অভ্রখনিতে ওভারশিয়ার, হোটেলের ব্যবসা, মিষ্টির দোকান, মাখনের ব্যবসা, কিছুদিন সন্ন্যাসী হয়ে ঘুরে বেড়ানো..... অদ্ভুত বৈচিত্র্যময় কর্মজীবন! বহু পথ ঘুরে, জীবন ও জীবিকার অভিজ্ঞতার ঝুলিটি পূর্ণ করে শেষে ১৯৩৯-এ একটি সংবাদপত্রে যোগ দেন। সহকারী সম্পাদক পদে নিযুক্ত হয়ে ক্রমে সিনিয়র সহকারী সম্পাদক তারপরে অন্যতম সম্পাদকীয় লেখক হিসেবে পদোন্নতি ঘটেছিল তাঁর।

"অযান্ত্রিক" এবং "ফসিল" - এর পর একে একে লিখে চলেন বেশ কিছু অসাধারণ ছোটগল্প যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল "যতুগৃহ", "থির বিজুরি", "ঠগিনী", "সুন্দরম", "পরশুরামের কুঠার", ইত্যাদি। "তিলাঞ্জলী", "গঙ্গোত্রি", "শুন বরনারী"-র মতো উপন্যাসও লিখেছে তাঁর কলম। ছোটগল্প বা উপন্যাস যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলিয়েছেন। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি মহাভারতের ভালবাসার উপাখ্যান নিয়ে ‘ভারত প্রেমকথা’র মতো মহাকাব্যিক লেখা তাঁর কলমই উপহার দিয়েছে। তাঁর গল্প-উপন্যাস যে শুধু বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে তা-ই নয়, রুপোলি পর্দায় উপস্থাপিত হয়ে দর্শকের মন কাড়তেও সক্ষম হয়েছে। ১৯৫৬ সালে উত্তম-সুচিত্রার "ত্রিযামা"। দু’বছর পরে ঋত্বিক ঘটক তৈরি করেন "অযান্ত্রিক"। এর পরে একে একে "শুন বরনারী", "শিউলিবাড়ি", "জতুগৃহ", "ঠগিনী"। হিন্দিতে ১৯৫৯ সালে বিমল রায় তৈরি করেন "সুজাতা"। অনেক বছর পরে "জতুগৃহ" অনুসরণে "ইজাজত" নামের একটি ছবি তৈরি করেন গুলজ়ার। এর মধ্যে "সেদিন চৈত্রমাস" অবলম্বনে তৈরি হয়েছে "চিতচোর"। পরে "সেদিন চৈত্রমাস" নামেও একটি বাংলা চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল। প্রত্যেকটি সিনেমা মানুষের মনে দাগ কেটে গিয়েছিল।

সাহিত্য অঙ্গনে এত উজ্জ্বল গল্প-উপন্যাসরূপী মণি রত্ন সৃষ্টি করলেও পুরস্কার বলতে আনন্দ পুরস্কার আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক ছাড়া আর কোনো সেরকম বড় পুরস্কার পান নি সুবোধ বাবু। এই নিয়ে তিনি কখনো আক্ষেপ না করলেও তাঁর পুত্রদের মনে একটু অভিমান রয়ে গেছে।

৯ই মার্চ ১৯৮০...প্রয়াত হন সুবোধ ঘোষ। তাঁর মৃত্যুর পরে স্মৃতিচারণায় আশাপূর্ণা দেবী লিখেছিলেন, ‘'তিনি এলেন, দিলেন, জয় করলেন।’'...সত্যিই তিনি পাঠকের হৃদয় জয় করেছিলেন উল্কার বেগে এসে। আজ, ১৪ই সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিনে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই এই অসামান্য সাহিত্যিককে।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...